প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ব্যাপারে তথ্য পেতে এফবিআইর এজেন্ট রবার্ট লাস্টিকের কাছে শফিক রেহমানের নাম উল্লেখ করে টাকা পাঠানো হয়। ডিবির দাবি, তথ্য দেওয়ার বিনিময়ে লাস্টিককে ৪০ হাজার ডলার দেওয়ার কথা থাকলেও তাকে শেষ পর্যন্ত ৩০ হাজার ডলার দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ হেফাজতে শফিক রেহমান বলেছেন, হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে কর-সংক্রান্ত ঝামেলা এড়াতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক মিল্টন ভুঁইয়া তার নাম ব্যবহার করে এফবিআইর এজেন্টকে অর্থ দিয়েছিল। তবে ডিবি তার এমন যুক্তি মানতে রাজি নয়।
তদন্ত করে দেখা হচ্ছে, এফবিআইর এজেন্টকে দেওয়া অর্থ মূলত কার কাছ থেকে গিয়েছিল। এর জোগানদাতা কে? জয়কে অপহরণে আরও কোনো 'উচ্চ পর্যায়ের' ষড়যন্ত্র ছিল কি-না, তা জানতে বিশদ তদন্ত চলছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা এখনও মনে করছেন, জয়কে অপহরণ পরিকল্পনার সঙ্গে এরই মধ্যে যাদের নাম এসেছে, তারা ছাড়াও পর্দার আড়ালে অন্য কেউ থাকতে পারে। হয়তো তারাই অর্থের জোগানদাতা।
এদিকে, আজ বৃহস্পতিবার শফিক রেহমানের পাঁচ দিনের রিমান্ড শেষ হচ্ছে। শুক্রবার তাকে আদালতে হাজির করে নতুন করে রিমান্ড আবেদন করা হতে পারে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, মিল্টন ভুঁইয়াকে গ্রেফতার করা গেলে ৩০ হাজার ডলারের উৎস সম্পর্কে জানা যাবে। এই অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাঠানো হয়েছিল, নাকি যুক্তরাষ্ট্রে সংগ্রহ হয়-তা জানা যাবে। শফিক রেহমানের নামেই এফবিআইর এজেন্টকে ঘুষ দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত রয়েছে। শফিক রেহমান বলছেন, মিল্টন হয়তো কর-সংক্রান্ত ঝামেলা এড়াতে তার নাম ব্যবহার করেছে।
একটি সূত্রের দাবি, বিএনপির কোনো কোনো নেতা দেশ থেকেই এ টাকার জোগান দেন। চুক্তির পর এফবিআইর এজেন্ট লাস্টিককে টাকা দিতে বিলম্ব হচ্ছিল। এ জন্য টাকা জোগাড় করতে ২০১২ সালে জাসাসের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুন বাংলাদেশে ছুটে আসেন। তখন বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকা আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করেন। ওই সময় মাহমুদুর রহমানের সঙ্গে মামুনের পরিকল্পনা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্যবিনিময় হয়।
ডিবি মনে করছে, ওই সময় টাকার জোগানের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। মাহমুদুর রহমানকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় ডিবি। এরই মধ্যে জয়ের মামলায় তাকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। এর শুনানি আগামী ২৫ এপ্রিল।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শফিক রেহমান তথ্য দিয়েছেন। তিনি এও বলেছেন, তার ই-মেইলে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সম্পর্কে সব তথ্য আসে। তিনি এফবিআই এজেন্ট লাস্টিক ও মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনের ছেলে রিজভী আহমেদ সিজারের নির্দেশে তা ই-মেইল থেকে মুছে দেন। অবশ্য তার আগে এসব তথ্যের প্রিন্ট কপি রেখে দেন। শফিক রেহমানের বাসায় সংরক্ষিত নথিগুলো উদ্ধারের পর দেখা গেছে, এতে সজীব ওয়াজেদ জয় বিমানে কোথায় যান, কখন যান সে তথ্য রয়েছে। তার গাড়ির রঙ এবং মডেল নম্বরও রয়েছে। তিনি কোথায়-কখন অবস্থান করেন, বাসায় প্রবেশ করেন কখন এসব তথ্যও রয়েছে। কারও ব্যাপারে এসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা স্বাভাবিক বিষয় নয়।
ডিবির কর্মকর্তাদের দাবি, সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণচেষ্টার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতারের পর দণ্ড পাওয়া রিজভী আহমেদ সিজার, তার বন্ধু জোহান্স থ্যালার ও এফবিআইর স্পেশাল এজেন্ট রবার্ট লাস্টিক তাদের জবানবন্দিতে শফিক রেহমানের কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে দেওয়া এ তিনজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শফিক রেহমান, বাংলাদেশের কারাগারে আটক একজন সম্পাদক ও ব্যবসায়ী মিল্টন ভুঁইয়ার নাম রয়েছে। তদন্তে দেখা যায়, সেখানে সম্পাদক বলতে মাহমুদুর রহমানের কথা বলা হয়। ওই জবানবন্দির তথ্য-উপাত্ত ঢাকার ডিবির হাতেও রয়েছে।
তবে শফিক রেহমানের স্ত্রী তালেয়া রেহমান বলেছেন, শফিক রেহমান এ ধরনের ষড়যন্ত্রে যুক্ত হতে পারেন না। তিনি মানুষকে ভালোবাসার কথা বলেন।
কে এই মিল্টন ভূঁইয়া? :
সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ করে হত্যা পরিকল্পনার বিষয়ে ঘুরেফিরে মিল্টন ভুঁইয়ার নাম আসে। তবে তার পরিচয় সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ওই ঘটনায় দায়ের মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মিল্টন ভুঁইয়া ব্যবসায়ী। তার বয়স ৫০ বছরের কাছাকাছি। বাড়ি চট্টগ্রামে। পেশায় তিনি কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার। বেশির ভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। বাংলাদেশে এলে তিনি গুলশানের একটি পাঁচতারকা হোটেলে অবস্থান করেন। চট্টগ্রামে তার বাড়ি থাকলেও ঢাকায় বাড়ি নেই। অনেক আগে থেকেই তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দলটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও তার নিয়মিত যোগাযোগ হয়।
তবে তিনি দলের কোনো পদে রয়েছেন কি-না, তা ওই সূত্র নিশ্চিত করতে পারেনি। ডিবি পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে মিল্টন ভুঁইয়া বাংলাদেশে আসেন। তখন তার বাবা অসুস্থ হয়ে ঢাকার পান্থপথে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর গত জানুয়ারি মাসে তিনি বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তবে ওই সময়ে তার বিষয়ে গোয়েন্দাদের হাতে তথ্য না থাকায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি।
ডিবি পুলিশ জানায়, জয়কে অপহরণ চক্রান্তের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে তিনজনের দণ্ড হওয়ার পর বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর হয়। ওই ঘটনায় ২০১৫ সালের মে মাসে ঢাকার রমনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে পুলিশ। এটি তদন্তে মূল ষড়যন্ত্র নয়াপল্টনে জাসাস কার্যালয়ে হয়েছে-এমন তথ্য পেয়ে পল্টন থানায় 'অপহরণ ও হত্যাচেষ্টা' মামলা হয়। মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমান ও মিল্টন ভুঁইয়ার নাম বেরিয়ে আসে। ওই মামলাতেই গত শনিবার সকালে বিএনপি-ঘনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় ডিবি।
বিবার্তা/এম হায়দার