রাজধানীর ধানমন্ডির একটি সরকারি বাড়ির নামে জাল দলিল তৈরি করে ২০ কোটি টাকার লোন নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২০০৯ সালের ২৮ এপ্রিল সাউথ ইস্ট ব্যাংকের ইস্কাটন শাখা থেকে এ লোন নিয়েছেন ইউরোকোলার চেয়ারম্যান হারুন উর রশীদ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইউরোকোলার চেয়ারম্যান হারুন উর রশীদ ধানমন্ডির ১৮০/এ রোড নং-২০(পুরাতন) নতুন ১০/এ বাড়িটির নামে জাল দলিল তৈরি করে ব্যাংক থেকে লোন নেন। এক বিঘা জমির ওপর ওই আলিশান বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে। বাড়িটির প্রকৃত মালিক ডা. সৈয়দ মুজিবর রব। তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারদের ভয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান।
এরপর থেকে এ বাড়িটি সরকারের অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ছিল। ২০০১ সালে সরকারের কাছ থেকে বাড়িটি বরাদ্দ নেন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তাইজুল ইসলাম খান ও উপ-সচিব মো. আহমেদুর রহিম। বরাদ্দ পাওয়ার পর তারা তাদের পরিবার নিয়ে বাড়িটিতে থাকতেন। আর এ জন্য তাদের প্রতি মাসের বেতন থেকে বাড়ি ভাড়া কেটে রাখা হতো।
বাড়িটির মালিক ডা. সৈয়দ মুজিবর রবের নাতি দেলোয়ার হোসেন বিবার্তাকে জানান, ২০০৫ সালে ১৮ এপ্রিল যুগ্ম সচিব ও উপ-সচিবের সামনে ৮০/৮৫ জনের একটি সস্ত্রাসী দলের সদস্যরা পুলিশের পোশাক পরে ওই বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। এ সময় যুগ্ম সচিব ও উপসচিব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কোন থানার পুলিশ জিজ্ঞাসা করলে সস্ত্রাসীদের মধ্য কয়েকজন পুলিশসহ একজন ধানমন্ডি থানার এসআই মনিরুজ্জামান বলে পরিচয় দেন। তারা তখন বলেন, আদালতের নির্দেশে এখানে এসেছি, দ্রুত বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারবো না।
তখন দুই সচিব ধানমন্ডি থানা ও পূর্ত মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি জানান। ওই দিন রাত সাড়ে ৯টায় তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী মীর্জা আব্বাস ঘটনাস্থল গিয়ে বলেন, এ বাড়িটি সরকারি সম্পত্তি। এর পর তারা হামলার ভয়ে মালামালসহ বাড়িটিতে তালা বদ্ধ করে আত্মীয়দের বাসায় চলে যান।
পরের দিন সরকারের এ দুই কর্মকর্তা পূর্তসচিব ইকবাল উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর দুই কর্মকর্তা আবাসন অধিদফতরের পরিচালকের কাছে চিঠি দিয়ে সরকারি এ বাড়ির দখল বুঝে নেয়ার অনুরোধ করেন। ২০ এপ্রিল বাড়ি ছেড়ে দেন এ দুই কর্মকর্তা।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৭ সালে দেশে ফিরে আসেন ডা. সৈয়দ মুজিবর রব। ১৯৮৭ সালের ২০ নভেম্বর অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালে তিনি মারা যান। এরপর একটি ভুয়া দলিল তৈরি করে শরীফ উল্লাহ পাটোয়ারী নিজেকে বাড়িটির মালিক দাবি করে বলেন, মুত্যুর আগে টাকা নিয়ে স্ট্যাস্প করে সব জমি তার নামে লিখে দিয়ে গেছেন মুজিবর রব। এখন তাকে জমির দলিল করে দিতে হবে।
এরপর ১৯৮৯ সালে স্ট্যাম্পের চুক্তি বলে ঢাকা তৃতীয় সব-জজ আদালতে ডা. সৈয়দ মুজিবর রবের ওয়ারিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন শরীফ উল্লাহ পাটোয়ারী। আদালতে ডা.সৈয়দ মুজিবর রবের স্বাক্ষর জাল প্রমাণিত হয়।
এরপরে ১৯৯৯ সালে ইউরোকোলার চেয়ারম্যান হারুন উর রশীদের প্ররোচনায় শরীফ উল্লাহ পাটোয়ারী ফের বাড়িটির মালিকানা দাবি করে ঢাকা যুগ্ম জেলা জজ আদালতে একটি মামলা করেন। মামলা নম্বর ১১৫। এ মামলায় বাড়িটির প্রকৃত মালিক সৈয়দ মুজিবর রবের নাতি দেলোয়ার হোসেকে প্রধান, ঢাকার ডিসিকে দ্বিতীয় এবং পূর্ত মন্ত্রণালয়কে তৃতীয় বিবাদী করা হয়। ডিসি ও পূর্ত সচিব ইকবাল উদ্দিন চৌধুরীসহ কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে মামলার একতরফা রায় পান ইউরোকোলার চেয়ারম্যান হারুন উর রশীদ। ২০০৫ সালে ১৩ এপ্রিল উচ্ছেদের আদেশ দেন আদালত। পূর্তমন্ত্রীকে না জানিয়ে উচ্ছেদের নোটিশ গোপন রেখে ১৮ এপ্রিল উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়।
২০০৭ সালে রাজধানীর মুহাম্মদপুর সাব-রেজিস্টার অফিসে ইউরোকোলার চেয়ারম্যান হারুন উর রশীদ নিজ নামে একটি দালিল বের করেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে ডা. সৈয়দ মুজিবর রবের নাতি মো. দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে আদালতে মামলা করেন। মামলা নম্বর ৮২১।
ওই মামলায় হারুর উর রশীদের দলিল জাল প্রমাণ হয়। ২০০৭ সালের ২৫ অক্টোবর গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কাজী শরিকুল আলম ৭ দিনের মধ্য হারুন উর রশীদকে ওই বাড়ি ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই নির্দেশনা না মেনেই ওই নোটিশের বিরুদ্ধে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দাখিল করেন হারুন উর রশীদ। যার নম্বর ৯৪৯২।
আদালত ২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবর রিট পিটিশনটি খারিজ করে দেন। এরপর গণপূর্ত সচিবের সহযোগিতায় ছাড়পত্র বের করেন দোলোয়ার হোসেন। চলতি বছরের ১মার্চ ঢাকা যুগ্ম জেলা জজ সাউদ হাসানের তৃতীয় আদালতে হারুন উর রশীদের দলিল আবারো জাল প্রমাণিত হয়। যার নম্বর ১০১।
এদিকে ২০০৯ সালের ২৮ এপ্রিল সাউথ ইস্ট ব্যাংক ইস্কাটন শাখা ম্যানেজারকে ম্যানেজ করে বাড়িটির মালিকানা দেখিয়ে ২০ কোটি টাকা লোন নেন ইউরোকোলার চেয়ারম্যান হারুন উর রশীদ । ব্যাংক লোনের শর্ত অনুযায়ী জমির নামজারি ও জমা ভাগের প্রস্তাবপত্রে ব্যাক্তিগত মালিকানা থাকতে হবে। কিন্তু এই জমির মালিকানায় সরকারি নাম রয়েছে।
দেলোয়ার হোসেন বিবার্তাকে বলেন, আমার দাদা কারো কাছ থেকে কোনো টাকা নেয়নি। ওই স্বাক্ষর আমার দাদার নয়। যা আদালতে প্রমাণিত হয়েছে। এই জমির প্রকৃত মালিক আমার দাদা সৈয়দ মজিবর রব। আমি তার একমাত্র ওয়ারিশ।
তিনি আরো বলেন, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সাউথ ইস্ট ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দাখিল করেছি। আশা করি আমি ন্যায় বিচার পাবো।
ইউরোকোলার চেয়ারম্যান হারুন উর রশীদ বিবার্তাকে বলেন, ক্রয়সূত্রে এই বাড়ির মালিক আমি। বাড়ি বন্ধক রেখে আমি লোন নিতেই পারি। দেলোয়ার হোসেন টাকার লোভে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলেছেন।
সাউথ ইস্ট ব্যাংক ইস্কাটন শাখা ম্যানেজারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। পরে শরিফ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিবার্তাকে বলেন, সঠিকভাবে তদন্ত করার পর লোন দিয়েছি। ইউরোকোলা আমাদের অনেক বড় গ্রাহক। তাই তারা চাইলে এ টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। তাই এ নিয়ে চিন্তা করছি না।
এ বিষয়ে অভিযোগ পেয়েও তদন্ত করছেন না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত করার সময় এখনো হয়নি। ইউরোকোলা আমাদের সঙ্গে ভালো লেনদেন করছে। এসময় তিনি সংশ্লিষ্ট কোনো কাগজপত্র দেখাতে রাজি হননি। উল্টো তিনি এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে ৬০ পৃষ্ঠার সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র কপি করে নেন।
বিবার্তা/বশির ও আসাদ/রয়েল /কাফী