কলাবাগানে জোড়া খুনে জড়িত পাঁচ খুনি ছিল খুবই বেপরোয়া। প্রশিক্ষিত এই উগ্রপন্থিরা কমান্ডো স্টাইলে ইউএস এইড কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়কে হত্যা করে পালিয়ে যায়। ফ্ল্যাটের নিরাপত্তা কর্মীদের বাধার মুখে পড়লে একজনকে কুপিয়ে আহত ও আরেকজনকে অপেক্ষমাণ কক্ষে আটকে রাখে তারা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে কিলিং মিশন সম্পন্ন করে পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরা পড়লে তা ঠেকানোরও সব ধরনের প্রস্তুতি ছিল তাদের।
সব মিলিয়ে অন্তত ২০ মিনিটের অপারেশনে পুলিশের তল্লাশি এড়াতে ঘটনাস্থল থেকে সংক্ষিপ্ত পথে না গিয়ে অন্তত এক কিলোমিটার হেঁটে ও দৌড়ে পালিয়েছে জঙ্গিরা। এদিকে জুলহাজ ও তনয়কে হত্যার পর বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। পুলিশ বলছে, উগ্রপন্থি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) সদস্যরা কলাবাগানের জোড়া খুনে জড়িত।
বিভিন্ন সময় ব্লগার হত্যার সঙ্গে এ হামলার সাদৃশ্য রয়েছে। এর আগে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা ও আহমেদুর রশিদ টুটুলসহ তিনজনকে কুপিয়ে আহত করা হয়। দীপনের ঘাতক দলের ও টুটুলের ওপর হামলাকারীদের দু'জন জুলহাজ ও তনয় হত্যা মিশনেও অংশ নেয়। সিসিটিভির ফুটেজ ও অন্যান্য আলামত বিশ্লেষণ করে এ তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা।
তবে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত হামলাকারীদের গ্রেফতার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ঘটনায় কলাবাগান থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে দুটি মামলা হয়েছে। এর তদন্ত প্রতিবেদন আগামী ২৪ মে দাখিল করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এদিকে জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়কে হত্যার 'দায় স্বীকার' করেছে আল কায়দা ভারতীয় উপমহাদেশের (একিউআইএস) কথিত বাংলাদেশ শাখা আনসার আল ইসলাম। যদিও বরাবরের মতো এই দাবিকে 'ভিত্তিহীন' বলছেন গোয়েন্দারা।
জুলহাজ ও তনয়কে হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ঘটনার তদন্তে তারা বাংলাদেশকে সহায়তা করতে চেয়েছে। তদন্ত শুরু করেছে এফবিআই। জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংস্থা নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সাবেক প্রটোকল সহকারীও ছিলেন জুলহাজ। হিজড়া ও সমকামীদের অধিকার আদায়ের মুখপত্র 'রূপবান' নামে এক সাময়িকীর সম্পাদক তিনি।
জুলহাজ মান্নানের বড় ভাই মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, 'সমাজে ভিন্ন চিন্তার লোক থাকতে পারে। সবারই আলাদা আলাদা চিন্তা করার অধিকার আছে। ভিন্ন চিন্তার জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে এমনভাবে হত্যা করা হবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না।'
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, 'অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশে জঙ্গি তৎপতায় যে টার্গেট কিলিং হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জড়িতদের শনাক্তে গোয়েন্দারা কাজ করছেন।'
পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, 'এটা সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হত্যকাণ্ডের আগে এলাকা রেকি করা হয়েছে। ব্লগার ও লেখকদের হত্যার সঙ্গে জোড়া খুনের মিল রয়েছে।'
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (দক্ষিণ) মাশরুকুর রহমান খালেদ বলেন, 'নানা আলামত ও তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে খুনিদের আইনের আওতায় আনতে একাধিক দল কাজ করছে। দ্রুত রহস্য উন্মোচিত হবে।'
যেভাবে পালাল খুনিরা :
মঙ্গলবার ঘটনাস্থলের আশপাশ এলাকায় ঘুরে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খুনিরা নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে আবাসিক এলাকার অলিগলি বেছে নেয়। উত্তর ধানমণ্ডির আছিয়া নিবাস নামের ৩৫ নম্বরের বাসাটির আশপাশের পুরো এলাকা তাদের রেকি করা ছিল। বাসা থেকে বের হয়ে পান্থপথের প্রধান সড়কে যাওয়ার খুব সহজ দুটি পথের একটিকেও ব্যবহার করেনি তারা। বরং বিকল্প পথ হিসেবে লেক সার্কাস এলাকার বেশ কয়েকটি গলি পেরিয়ে ডলফিন গলির লেক ভিউ জামে মসজিদের সামনে দিয়ে কলাবাগানের প্রধান সড়ক লাজ ফার্মা লাগোয়া মিরপুর রোডে আসে।
ঘটনাস্থল থেকে ডলফিন গলি দিয়ে মিরপুর রোডে যেতে মোটামুটি ১৫ মিনিট সময় লাগে। ওই বাসা থেকে বের হয়ে হাতের বাঁদিকে কয়েক গজ এগিয়ে বাঁয়ের রাস্তা ধরে দুই মিনিটের মধ্যে পান্থপথের প্রধান সড়কে চলে যাওয়া যায়। তারা এ পথে না গিয়ে বাসা থেকে ডানের পথ ধরে তেঁতুলতলা ঈদগাহ মাঠের পশ্চিম পাশের রাস্তা ধরে দক্ষিণ পাশ দিয়ে লেক সার্কাস এলাকায় ঢুকে যায়। ওই সড়ক দিয়ে সোজা বশিরউদ্দিন রোডে যাওয়া যায়। তারা সেদিকে না গিয়ে কিছুদূর এগিয়ে ডান দিকের একটি সরু গলি দিয়ে ডলফিন গলি হয়ে মিরপুর সড়কে চলে যায়। এক যুবক তার মোবাইলে ভিডিও করার সময় দুর্বৃত্তদের একজন তাকে চাপাতি দিয়ে আঘাত হানার চেষ্টাও করেছে।
সুরতহাল রিপোর্ট :
মঙ্গলবার ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, 'হত্যার ধরন দেখে মনে হচ্ছে, খুনিরা প্রশিক্ষিত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল হত্যা নিশ্চিত করা। দু'জনের শরীরে আঘাতের চিহ্ন একই ধরনের। দু'জনের শরীরেই ধারালো অস্ত্রের আঘাত রয়েছে। এলোপাতাড়ি কোপানোর কারণে মাথার মগজ বের হয়ে গেছে। জুলহাজের হাতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, হামলা ঠেকাতে গিয়ে তিনি হাতে আঘাত পান।' এর আগে লাশের সুরহতাল প্রতিবেদন তৈরি করেন কলাবাগান থানার এসআই আনসার আলী।
ব্যাগে যা আছে :
পুলিশ জাপটে ধরে খুনিকে ধরতে না পারলেও একটি ব্যাগ কেড়ে রেখেছে। এই ব্যাগটিই খুনি শনাক্তে 'বড় আলামত' বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাই রঙের ব্যাগটিতে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যায়। এর একটি ৭ দশমিক ৬৫ পয়েন্টের আমেরিকার তৈরি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিনের ভেতর তিন রাউন্ড গুলি। অপর আগ্নেয়াস্ত্রটির সামনের দিকে ব্যারেলের মতো দুটি ছিদ্র রয়েছে। দুটি ব্যারেলেই দুই রাউন্ড গুলি পাওয়া গেছে। ১৩ ইঞ্চি লম্বা একটি চাপাতি পাওয়া গেছে। আরও পাওয়া গেছে, একটি পুরনো লাল চেকের গামছা, পুরনো একটি সাদা-নীল ও ছাই রঙের লুঙ্গি। ওই ব্যাগে একটি সাদা রঙের কাগজে বাংলা ও আরবিতে কিছু লেখা পাওয়া গেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, 'এটিই গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে কাজে দেবে।'
জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব তনয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সোমবার গভীর রাতে পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাটির বাদী হয়েছেন নিহত জুলহাজের বড় ভাই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন এবং কলাবাগান থানার উপপরিদর্শক শামীম আহমেদ। এতেও অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ থেকে ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে।
এক যুবক তার মোবাইলে ভিডিও করার সময় দুর্বৃত্তদের একজন তাকে চাপাতি দিয়ে আঘাত হানার চেষ্টাও করেছে।
শোকাচ্ছন্ন স্বজনরা :
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে জুলহাজের মরদেহ উত্তর ধানমণ্ডির তেঁতুলতলা মাঠে নেওয়া হয়। দুপুরে সেখানে জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। এ সময় তার বড় ভাই মিনহাজ মান্নান জানান, জুলহাজকে কেউ হত্যার হুমকি দিয়েছিল কি-না, তা তাদের জানা নেই। কখনও নিজের কোনো শঙ্কার কথাও জানাননি তিনি।
এদিকে নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়ের লাশ মিরপুরের জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর আগে মর্গ থেকে তনয়ের মরদেহ শিল্পকলা একাডেমিতে নিলে সহকর্মীরা শেষ শ্রদ্ধা জানান।
মঙ্গলবার দুপুরে তনয়ের লাশ মিরপুরের বাসায় নিলে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। কাঁদতে কাঁদতে তার মা বলেন, 'ছোট বাচ্চারা যেভাবে কোলবালিশ নিয়ে ঘুমায়, আমার ছেলেও সেভাবেই ঘুমাত।
জুলহাজের চাচা আমিনুল হোসেন বলেন, বাসায় ঢুকে মান্নানকে কোপানোর সময় তার বৃদ্ধ মা ছেলের আর্তনাদ শুনে এগিয়ে যান। ঘাতকদের কাছে জানতে চান, 'তার ছেলের কী অপরাধ।' এ সময় ঘাতকদের একজন তার দিকে চেয়ার ছুড়ে মারেন। এতে পায়ে আঘাত পান তিনি।
তনয়ের বোন জাকিয়া রাব্বী বলেন, 'আমার ভাই বেসরকারি আশা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়াশোনা করতেন। নাটকের কারণে পড়াশোনায় বিরতি ছিল। ঘটনার দিন প্রথম সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে তনয়ের নাটকের মহড়ায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল।' তনয় কেন জুলহাজের বাসায় গিয়েছিলেন, তা জানেন না তারা।
তনয়ের বাবা খন্দকার নূরে রাব্বী বিদেশি একটি জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছেলের হত্যাকাণ্ডের খবরে মঙ্গলবার তিনি দেশে ফিরেছেন। তাদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে।
বিবার্তা/এম হায়দার