বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক গভীর হচ্ছে

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক গভীর হচ্ছে
প্রকাশ : ২১ মে ২০১৬, ২৩:১৭:৩৭
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক গভীর হচ্ছে
ফারজানা আক্তার
প্রিন্ট অ-অ+
নির্বাচনে জয়ের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিলেও দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে সু চিই প্রেসিডেন্ট। পাঁচ দশকে মিয়ানমারের যে আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা চলছিল তা দূর করতে চেষ্টা চালাচ্ছেন সু চি। তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের সাথে তৈরি হওয়া অবিশ্বাসের সম্পর্ক পরিবর্তনে উদ্যোগী হয়েছে দেশটি।
 
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তের ২৭১ কিলোমিটার, যার প্রায় ১৫০ কিলোমিটারই পাহাড়ি অঞ্চল ও সমুদ্র দিয়ে ব্যাপৃত। অতীতে দুটি দেশের সম্পর্ক সীমান্ত বিরোধ এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অভিবাসন নিয়ে বিবাদের কারণে উত্তেজনা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে।

এমনকি দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষও হয়েছে বহুবার। বাংলাদেশে সমুদ্রসীমার অন্তর্ভুক্ত এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের (ইইজেডএস) ওপর মায়ানমারের হস্তক্ষেপ নিয়েও দুই দেশের মধ্যকার টানাপোড়ন সৃষ্টি হয়। ওই সময় মিয়ানমারের অন্বেষণ কার্যক্রমে বাধা দিতে তিনটি নৌ জাহাজ পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ।

সামুদ্রিক সীমানার অধিকার নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ আন্তর্জাতিক সালিশের মাধ্যমে সমাধান হওয়ার পরও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের শীতলতা অব্যাহত ছিল। তবে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর উল্লেখযোগ্যভাবে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়েছে। ফলে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সঙ্গেও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

১৯৬২ সালের অভ্যুত্থানের পর মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর নের্তৃত্বাধীন সরকার সংকীর্ণ জাতীয় অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত করেছিল দেশকে। রাজনৈতিক সমাধানের চেয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সঙ্কট নিরসনে তারা সামরিক সমাধানের ওপরেই জোর দিয়েছে বেশি।

২০১৫ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নিরুঙ্কুশ জয় লাভের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

৫০ বছরেরও বেশি সময় পর প্রথম নির্বাচিত বেসামরিক নেতা থিন কিয়াও দেশটির নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছেন। ক্ষমতায় আসার পরই বিস্তৃত সংস্কার কার‌্যক্রম শুরু করেছেন তিনি।
 
মিয়ানমার-বাংলাদেশ সম্পর্কে বড় বাধাগুলো ছিল রোহিঙ্গা ইস্যু, সমুদ্রসীমা ও নাফ নদী সীমানা নিয়ে বিরোধ। তবে এখন শুধু মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ বিষয় নিয়েই বিতর্ক চলছে। অন্য সমস্যাগুলোও আর আগের মতো তীব্র নয়। কয়েক বছর ধরে মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যুর বিতর্কের আলোকে বাংলাদেশকে দেখেছে।
 
বাংলাদেশও রাখাইন রাজ্যের এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারকে বিবেচনা করেছে। তবে মিয়ানমার এখন উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে, দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। বাংলাদেশ শরণার্থী ইস্যু সরিয়ে রেখে মিয়ানমারের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে ইচ্ছুক।
 
বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নে প্রয়োজনীয়তা এনএলডির অন্যান্য জোষ্ঠ নেতারাও উপলব্ধি করেছেন। নাফ নদীর সীমানা নির্ধারণ করার পর বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন  করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না করার পক্ষে অং সান সু চি’র বিশ্বস্ত পৃষ্ঠপোষক ইউ টিনেরও।
 
তিনি বলেছেন,  মায়ানমারের নতুন সরকার বাংলাদেশসহ সব প্রতিবেশীর সঙ্গেই আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। মিয়ানমারের ফরেন রিলেশনস কমিটির সচিব বো বো ঘোষণা দিয়েছেন, নতুন সরকার ঢাকার সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।

বাংলাদেশও মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিবর্তন উপলব্ধি করেছে বেশ আগেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রথম বিশ্ব নেতা, যিনি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর সু চিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বাংলাদেশ মনে করে নতুন এ মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে।
 
মিয়ানমারের ভৌগলিক কৌশলগত অবস্থান প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়েও দেশটি বেশ সমৃদ্ধ। চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এই দেশটি।
 
প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে দেশটি সম্ভাব্য গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে ওঠতে পারে। গুঞ্জন রয়েছে, বাংলাদেশে মজুদ গ্যাস দেশীয় চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়। বাংলাদেশও মিয়ানমারের শিউ গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস আমদানি করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে।

ভারত ও চীনকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারও এরইমধ্যে বিসিআইএম করিডোর নিয়ে কাজ শুরু করেছে। বলা হচ্ছে, এই করিডোর অঞ্চলটিতে বসবাসরত ৪০০ মিলিয়ন মানুষের অবস্থার উন্নতিতে কাজ করবে। করিডোরের পাশাপাশি মায়ানমারের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে চীনের কুনমিং শহর পর‌্যন্ত একটি রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চায় বাংলাদেশ।
 
এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে বেশ কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে।
 
এগুলোর মধ্যে একটা হলো দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার। এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ দুই দেশের সাংস্কৃতিক বন্ধনের বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ জন্য সম্প্রতি ইয়াঙ্গুনে বাংলাদেশ দূতাবাসে নববর্ষ উদযাপনের আয়োজন করা হয়, যেখানে ক্ষমতাসীন দলের বড় বড় রাজনীতিবিদদের বড় একটি অংশ উপস্থিত ছিলেন।
 
অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জনগোষ্ঠীর মধ্যকার সাংস্কৃতিক মিলগুলো তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক দল থেকে বেশিরভাগই ছিলেন মারমা, চাকমা ও ত্রিপুরা উপজাতি সদস্য। তারাই মূলত অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।
 
মিয়ানমারের রণতরীকে নিজ সীমানায় প্রবেশ করতে নাফ নদী ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ। এর আগে নিজ অংশে ফিরতে মায়ানমার  সীমান্তবর্তী কক্সবাজারে তাদের এক মাস অপেক্ষা করতে হতো। 
 
বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সংলাপ আযোজনের আলোচনা চলছে। পাশাপাশি সীমান্ত সংযোগ অফিস প্রতিষ্ঠার জন্যও আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া চলছে। দুই দেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে মিয়ানমার পঞ্চশীলা নীতি অনুসরণ গ্রহণ করছে।
 
পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণও বাড়াতে চায় দুই দেশ, বর্তমানে যার পরিমাণ ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে। বাংলাদেশের মতো মিয়ানমারও বিসিআইএম করিডোরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন পরিসরে সংযোগ বাড়াতে আগ্রহী।
 

মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয় দেশের কাছেই প্রতিবেশী নীতি অগ্রাধিকার পাচ্ছে। বলা হচ্ছে, সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বর্তমানে সবচেয়ে ভালো পর্যায়ে রয়েছে। ভারতের মতো বাংলাদেশও এখন তার অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিদ্যমান শীতলতা দূর করতে চায়। মিয়ানমারও তাই।   
 
নতুন সরকার আসার পর মিয়ানমারের পররাষ্ট্রনীতি অপরিবর্তিত রয়ে গেলেও সমস্যার মোকাবিলায়  কৌশলগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। মিয়ানমার-বাংলাদেশ উভয়েই নিজেদের রাজনৈতিক প্রস্তাবে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।
 
তবে, একই সময়ে, উভয় পক্ষই জানে বিদ্যমান বাধাগুলো এক দিনেই দূর হবে না। এটাকে মাথায় রেখেই দুই দেশ একে অপরের কাছে পৌঁছাতে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গভীর করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সূত্র : ইউরেশিয়াভিউ

বিবার্তা/ফারিজ/কাফী
 
 
 
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com