বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প সত্ত্বেও কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দ্বীপের অধিকাংশ অধিবাসী এখনো অন্ধকারে। দ্বীপটির পুরাতন শান্তি বাজারের এই বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রটি ১০ বছর ধরেই প্রায় অচল অবস্থায় রয়েছে।
জানা যায়, দিনে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য ১১১ জন গ্রাহককে বিদ্যুৎ দিচ্ছে এটি। তবে মাঝে মাঝে এলাকাবাসীকে সপ্তাহজুড়ে বিদ্যুৎহীন থাকতে হয়।
কুতুবদিয়া দ্বীপে সময় গড়িয়েছে, জোয়ারের উত্থান-পতনেও এসেছে পরিবর্তন। সবসময়ের মতো এখনো সৈকতে মানুষ লবণ উৎপাদন ও মাছ ধরায় ব্যস্ত। তবে দ্বীপের সীমিত বিদ্যুতের বিষয়টি যেন একটি অপরিবর্তনীয় বাস্তবতা।
সরকার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শেষ করেছে, পাশাপাশি আরেকটির কাজও চলছে। এসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কুতুবদিয়ার পৌণে দুই লাখ অধিবাসীর অধিকাংশই কয়েক দশক ধরে অন্ধকারে দিনযাপন করছে।
দক্ষিণ ধুরং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, শুধু প্রধান শহর বারো ঘোপে একটি ডিজেলচালিত জেনারেটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। এছাড়া দ্বীপের ছয় ইউনিয়নের পাঁচটিতেই নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় না।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রকৌশলী সাজ্জাদ সিদ্দিকের বলেন, শহরের ৪০০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর বর্তমানে সন্ধ্যা ৬টা থেকে প্রতিদিন পাঁচ ঘণ্টার জন্য ৭৪৬ জন গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।
জেনারেটরের বিদ্যুৎ সরবরাহের সুবিধাভোগী বারো ঘোপের অধিবাসী আরিফুল ইসলাম বলেন, ধনীরা সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। তবে এ সংখ্যা খুবই কম।
জেনারেটর থেকে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের সুবিধাও পাচ্ছেন না- বারো ঘোপের এমন বাসিন্দারা কেরোসিনের ওপরই নির্ভর করছেন। আল আজাদ বলেন, বিদ্যুৎ থাকলে হিমাগার এবং বরফ কারখানা তৈরি করা যেত, যা মৎস্যশিল্পের জন্য বেশ বড় একটা সমর্থন হিসেবে কাজ করতো। বিদ্যুৎ দ্বীপের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বিশাল অবদান রাখতো।
কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ আনার প্রথম চেষ্টা হিসেবে ১৯৮০ সালে ডিজেলচালিত জেনারেটর স্থাপন করা হয়। কিন্তু ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে জেনারেটরটি নষ্ট হয়ে যায় এবং চার বছরের ধরে এটা নষ্টই ছিল।
উপকূল সংলগ্ন আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের পুরাতন শান্তি বাজারে ২০০৫ সালে পিডিবির তত্ত্বাবধানে ১০০০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৫ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে প্যান এশিয়া পাওয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড। তবে বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্রমাগত ভাঙ্গনের কারণে কেন্দ্রের বিরাট একটি অংশ সমুদ্রে তলিয়ে গেছে।
১০ বছর ধরে অচল থাকার পর দুই মাস আগে এটা মেরামত করা হয়। বর্তমানে এর সুবিধাভোগী ১১১ জন গ্রাহক জানান, বিদ্যুৎ কতক্ষণ থাকবে তা খুবই অনিশ্চিত। কখনো টানা ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। মাঝে মাঝে এক সপ্তাহও থাকে না।
তালেবার চরে আট কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বিতীয় বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পের পরিচালক ফজলুর রহমান বলেন, সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশের যৌথ অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ করছে প্যান এশিয়া পাওয়ার সার্ভিসেস লিমিটেড।
কক্সবাজার পিডিবির ডিস্ট্রিবিউশন বিভাগের প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এক বছরের মধ্যে এটি চালু হচ্ছে। প্যান এশিয়াই বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে আর সরবরাহ করবে পিডিবি।
আবাসিক সংযোগের জন্য প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ধরা হয়েছে সাড়ে পাঁচ টাকা আর বাণিজ্যিক ভোক্তাদের জন্য এ হার সাড়ে নয় টাকা।
কুতুবদিয়ার সন্তান সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব এএমএম নাসির উদ্দিনের মতে এর হার অনেক বেশি। তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশে বায়ুবিদ্যুৎ সাধারণত কম খরচেই সরবরাহ করা হয়। কুতুবদিয়ায় এর দাম এত বেশি কেন, তার উত্তর খুঁজতে হবে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে অবকাঠামোকে রক্ষা করার মতো আধুনিক ও টেকসই সরঞ্জাম প্রকল্পে আছে কি-না প্রশ্ন করেন নাসিরুদ্দিন।
নির্মাণস্থলের খুব কাছেই থাকেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকার সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ না করায় নির্মাণকাজ খুবই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এমনকি প্রজেক্টের পরিচালকই মাঝে মাঝে থাকেন না।
স্থানীয় সাংবাদিক আরিফুল ইসলামও দাবি করেন, প্রথম প্রকল্পটিতে বেশ বড় মাপের দুর্নীতি হয়েছিল, এটা আবার পুনরায় ঘটার ব্যাপারে বেশ উদ্বিগ্ন তিনি।
নতুন প্রকল্পের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও কুতুবদিয়ায় বিদ্যুৎ সংকট মনে হয় আগের মতোই থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। দ্বিতীয় বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর এখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রস্তাবিত দামে দ্বীপটির কয় জন শিক্ষার্থী স্থায়ীভাবে নিজেদের কেরোসিনের হ্যারিকেন স্থায়ীভাবে তুলে রাখতে পারবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। সূত্র : ডেইলি স্টার
বিবার্তা/ফারিজ/কাফী