উপযুক্ত শাস্তির অভাবেই বাড়ছে অপরাধ

ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতি
উপযুক্ত শাস্তির অভাবেই বাড়ছে অপরাধ
প্রকাশ : ৩০ মে ২০১৬, ০৯:৪৩:৪৫
উপযুক্ত শাস্তির অভাবেই বাড়ছে অপরাধ
মৌসুমী ইসলাম
প্রিন্ট অ-অ+
ঘটেই চলেছে একের পর এক আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা। ব্যাংকের রিজার্ভ হ্যাক করে টাকা চুরি, কার্ড নকল করে টাকা তুলে নেয়াসহ চলছে নানা ধরনের অনিয়ম। আর এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন খোদ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। কিন্তু এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের সম্বন্ধে জানা গেলেও কাউকেই  দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হচ্ছে না। 
 
ধারাবাহিকভাবে এসব ঘটনা ঘটার ফলে একটি ইস্যুর নিচে চাপা পড়ে যাচ্ছে আরেকটি ইস্যু।ফলে সার্বিকভাবে দুর্নীতি ও অনিয়মের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো। 
 
প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত পাঁচ বছরে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক-বিমা-আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ডজনখানেক বড় ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
 
ব্যাংকের আমানতের অর্থ সরিয়ে ফেলা, ভুয়া ও নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ অনুমোদন, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, ভুয়া হিসাব খুলে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মতো নানা অনিয়মে ঘটনা হরহামেশা ঘটেই চলেছে। এসব অপরাধ করে কেউ কেউ দেশেই জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি কিনে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। কেউ আবার বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
 
সম্প্রতি বেসরকারি বিভিন্ন  ব্যাংকে কার্ড জালিয়াতি করে টাকা তুলে নেয়ার ঘটনায় গ্রাহকরা একপ্রকার আস্থাহীনতায় ভুগছেন। ইতিমধ্যে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বিদেশিসহ ব্যাংক কর্মকর্তাদের আটক করা হয়েছে। তবে এ ধরনের অপরাধ এবারই প্রথম হলেও এর আগে ব্যাংকের বড় বড় অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। যেসব ঘটনায় স্বয়ং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে থাকে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাও। কিন্তু দোষীদের সনাক্ত করা হলেও দৃশ্যত কোনো শাস্তি তাদের দেয়া হয়নি। 
 
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড.সালেহউদ্দীন আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, ব্যাংকের জালিয়াতির ঘটনায় অপরাধী চিহ্নিত হয়ে যথাযথ শাস্তি না পেয়ে অল্পতেই রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। এজন্য আর্থিক খাতে জালিয়াতি বেড়েছে। আর অধিকাংশ অনিয়মের সঙ্গে ব্যাংকের কর্মকর্তারা জড়িত। এটা খুবই দুঃখজনক। কারণ কর্মকর্তারা জড়িত থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। এতে এসব প্রতিষ্ঠানের উপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যায়। আর সম্প্রতি এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায়ও ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এসব অনিয়ম-দুর্নীতিতে যারা জড়িত তাদের কঠোরভাবে শাস্তি দেয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে যেন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। 
 
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, ব্যাংকিংখাতে সারা বিশ্বে কম-বেশি জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। কিন্তু এমন ব্যাপক আকারে ঘটে না। মালিকপক্ষের কারণে এসব অপরাধে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না।সরকারি মালিকানার ব্যাংকগুলোই পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে এমডি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত থাকে। একের পর এক রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকের পর্ষদ বিভিন্ন দুর্নীতি করেছে। কিন্তু তারপরও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আর বেসরকারি মালিকানার ব্যাংকগুলোই ব্যবসায়ী শ্রেণীর লোক জড়িত থাকে। সবাই মিলেমিশে এসব অনিয়ম করে। ফলে শাস্তি  দিতে পারে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর দুর্নীতি-অনিয়মে তদারকি জোরদার করতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক তো শাস্তি দিতে পারে না। এজন্য এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষকে আরো সজাগ হতে হবে।
 
বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রায় এক যুগ আগে ২০০৪-০৫ সালে ব্যাংকিং খাতে প্রথম বড় ধরনের দুর্নীতি হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের মাধ্যমে। ব্যাংকটিতে ৪৮৮ কোটি টাকার অনিয়ম সংঘটিত হয়। কিন্তু এ নিয়ে সে সময় অনেক হইচই হলেও পরে তা আড়ালে চলে যায়। উল্টো ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) সরকারের অন্য একটি ব্যাংকে একই পদে নিয়োগ দেয়া হয়।
 
তবে আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় জালিয়াতি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি। ওই ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয় হল-মার্কসহ ছয় প্রতিষ্ঠান। ২০১২ সালে এ অনিয়ম উদঘাটন হওয়ার পর এমডিকে অপসারণ ও পর্ষদ ভেঙে দেয়া হলেও দৃশ্যমান কোনো শাস্তি হয়নি জড়িত কর্মকর্তাদের।
 
এর পরপরই ২০১২ ও ২০১৩ সালে  প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয় রাষ্ট্রীয় বেসিক ব্যাংকে। এ ঘটনায় ২০১৪ সালে ব্যাংকটির এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পুরনো পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুন পর্ষদও গঠন করা হয়। এ ঘটনায়ও জড়িত কর্মকর্তাদের বিচার হয়নি। একই বছর বৈদেশিক বাণিজ্যে কৃষি ব্যাংকের প্রায় ৩১৮ কোটি টাকার অনিয়ম ধরা পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শনে। অনিয়ম ধরা পড়ার পর এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিটি অনিয়ম দূর করা হয়েছে মর্মে কৃষি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে লিখিতভাবে জানালেও যাচাই করে দেখা যায় ব্যাংকের বক্তব্য সঠিক নয়। 
 
গত বছর ব্যাংকিং বিধি ভঙ্গ করে ৫১৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটে রাষ্ট্রীয় অগ্রণী ব্যাংকে। তদন্ত প্রতিবেদনে দোষীদের সনাক্ত করা হলেও কোনো বিচার হয়নি। এছাড়া আরো একটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পর্ষদের নামে ৭০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। 
 
বিবার্তা/ মৌসুমী/জিয়া
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com