আগামী ২৫ জুন অনুষ্ঠেয় সফটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) নির্বাচনকে ঘিরে ইতিমধ্যেই সংগঠনটির সফলতা নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প অঙ্গনে শুরু হয়েছে বিতর্কের ঝড়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইসিটি খাতে সরকারের আগ্রহের কারণেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বেসিস নির্বাচন। সফটওয়ার উৎপাদন ও রপ্তানিতে সরকারের বিশেষ গুরুত্ব ও প্রণোদনার কারণে ট্রেড বডি হিসেবে বিশেষ গুরুত্বের জায়গায় এসেছে বেসিস। বর্তমান সরকার তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবে প্রতি বছর বেসিসকে বড় ধরনের প্রণোদনা দিয়ে আসছে। এই প্রণোদনার কতোটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছে সংগঠনটি, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এই নির্বাচনের মুখে বেসিস সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে আলোচিত হচ্ছে বেসিসের সফলতা-ব্যর্থতা।
সরকারি সুযোগ-সুবিধার পরও বেসিসের কার্যক্রমে হতাশা দেখা দিয়েছে খোদ সরকারের নীতি নির্ধারকদের মধ্যেই। ইতিমধ্যে গত ৮ মে ৭ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সভার আলোচনায় পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মোস্তাফা কামাল প্রকাশ্যে বেসিসের কার্যক্রম নিয়ে তার হতাশার কথা জানিয়েছেন। তিনি বেসিস সভাপতি শামীমের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আলিবাবা কোটি কোটি ডলার আয় করে, শামীম তোমরা কি করো?’
বেসিস সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সকল সরকারি প্রণোদনার সর্বোচ্চ ব্যাবহার নিশ্চিত করা উচিৎ। কারণ, বর্তমান কমিটির অধীনে দৃশ্যমান অনেক কিছুর উন্নয়ন হলেও প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেসিস অথবা বেসিস সদস্যদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। শুধু তাই নয়, কিছু বিষয় সরাসরি বেসিসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বেসিসের বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্বেষণ করলে দেখা যায় তারা বেশির ভাগ সরকারের উদ্যোগগুলোকে নিজেদের উদ্যোগ বা সফলতা হিসেবে প্রচার করেছে। অথচ এই উদ্যোগগুলোতে বেসিস মূলত সহযোগী পার্টনার হিসেবে কাজ করেছে। আবার এমন সব কাজে তারা সহযোগী হয়েছে, যার সাথে বেসিসের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কোনো মিল নেই।
এ খাতে সরকারের বিশেষ গুরুত্বের কারণে অ্যাসোসিয়েশনের প্রতি প্রত্যাশা বেড়েছে বেসিস সদস্যদেরও। তারা আশা করেন বেসিসের পক্ষ থেকে ইন্ডাস্ট্রিকে এগিয়ে নিতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া উচিত। সেই সাথে সরকারি সকল প্রণোদনার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত। সেদিক দিয়ে বেসিসের সদস্যদেরও মতামত মিশ্র। সদস্যরা মনে করেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেসিস ট্রেড বডি হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য বেসিস কার্যক্রমে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ফ্রিল্যান্সার তৈরি, স্টুডেন্টস ফোরাম তৈরির মতো বিষয়গুলো বেসিসের সঙ্গে যায় না। কিছু মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য এগুলো করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, তথ্যপ্রযুক্তি জনশক্তি তৈরিতে বিআইটিএম নামে বেসিসের ট্রেনিং একাডেমির উদ্যোগেরও প্রশংসা করেছেন কেউ কেউ। আবার কিছু সদস্য বলেন, এটা কোনোভাবেই বেসিসের কাজ হতে পারে না, বরং এই কাজটি সদস্যদের মধ্যে যাদের পেশাদারি ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের দিয়েই করানো যেত।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে জনশক্তি তৈরিতে সরকারের দেওয়া প্রণোদনার ব্যয় নিয়েও কিছু সদস্য তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাদের মতে, প্রণোদনার ব্যয় ঠিকমতো খরচ করা হয়নি।
বেসিসের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, বিআইটিম এর ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ ছাড়া আর কোনো কাযক্রম নেই সংগঠনটির। তবে বিভিন্ন থার্ড পার্টির প্রতিযোগিতার প্রমোশন নিয়ে কাজ করে বেসিস। এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে মিলে কিছু মেলার আয়োজন করে। নাম প্রকাশে না করার শর্তে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী অভিযোগ করেন, বেসিস প্রশিক্ষণের নামে যা দিচ্ছে তার পুরোটাই ভুয়া। আবার যেসব ফ্রিল্যান্সার প্রশিক্ষণ পাচ্ছে তার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
২০১৪ সালের শুরুতে সংগঠনটি এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দেশের সফটওয়্যার রপ্তানি আয় ২০১৮ সালের (পাঁচ বছরের) মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর ঘোষণা দেয়। আড়াই বছর পরে সেই লক্ষ্যমাত্রার সাথে অর্জনে অনেক তফাৎ দেখা যায়।
আর্থিক পরিমাণ হিসেব করলে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ অর্ধেক সময়ে বেসিসের অর্জন হওয়ার কথা ছিল সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি। কিন্তু বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে এই খাতে অর্জন হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার মত।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সফটওয়্যার এবং কম্পিউটার ও প্রযুক্তিবিষয়ক সেবা রপ্তানির আয়ে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রপ্তানি আয় এসেছে ১০ কোটি ৭০ লাখ তিন হাজার মার্কিন ডলার। টাকার অংকে যা ৮০০ কোটি টাকার বেশি। যার প্রবৃদ্ধির হার ৯ দশমিক ০৭ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরের ১১ মাসে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ছয় দশমিক ২২ শতাংশ। এটি ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ছয় দশমিক ২২ শতাংশ বেশি। তখন প্রবৃদ্ধি ছয় শতাংশ হলেও লক্ষ্যমাত্রা থেকে এ খাতের আয় ছয় দশমিক ১২ শতাংশ পিছিয়ে ছিল। এ সময়ে আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ১৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ২০১২-১৩ শেষে আয় ছিল ১০ কোটি ১৬ লাখ ডলার।
এ বিষয়ে বিবার্তার পক্ষ থেকে বেসিসের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শামীম আহসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বর্তমান মেয়াদের সফলতা বিষয়ে বিস্তারিতভাবে জানতে বেসিসের করা পরিসংখ্যান দেখার কথা বলেন তিনি।
প্রতিষ্ঠানটির পরিসংখ্যানে বলা হয়, তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে দেশের জিডিপিতে ১ শতাংশ অবদান রাখার ঘোষণার পিছনেও বিস্তর গবেষণা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে রফতানি আয় প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলো প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশ ব্যাংকের সি-ফর্মের জটিলতায় এটি সরকারি হিসেবে প্রায় ১৩২ মিলিয়ন ডলার, বাস্তবিক অর্থে এটি প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার) ও ফ্রিল্যান্স-আউটসোসিং পেশাজীবীরা প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে।
এদিকে কয়েক বছরে বেসিসের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সফটওয়্যার খাতের প্রবৃদ্ধি ক্রমশ কমেছে। সফটওয়্যার খাতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া ও দেশে এ শিল্পে বড় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে বেসিসের আন্তরিকতার অভাব দেখা দিচ্ছে বলে অভিযোগ তুলছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা।
প্রশ্ন উঠছে, যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের বাধা কোথায়? আঙুল উঠছে সফটওয়্যার শিল্পের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা বেসিস ও এর বতমান পরিচালনা কমিটির দিকে। কী পদক্ষেপ নিয়েছেন তারা? সফটওয়্যার ও তথ্য প্রযুক্তি রপ্তানি খাতে আমাদের এগিয়ে চলার জন্য বেসিস যুগোপযোগী যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ করছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা।
বিবার্তা/উজ্জ্বল/জিয়া