বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে গঠনতন্ত্রে এক নেতার এক পদ কার্যকর করা হয়েছে। জেলা, উপজেলা/থানার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অন্য কোনো কর্মকর্তা পদে আসীন হতে পারবেন না। স্থায়ী কমিটি ও উপদেষ্টা পদে যারা থাকবেন তারাও অন্য কোনো পদে আসীন হতে পারবেন না। এমন নিয়ম বেঁধে দেওয়ায় দলের অনেক শীর্ষনেতা থেকে শুরু করে মধ্যম সারির নেতারা বিপাকে পড়েন। কাউন্সিলের আগে বিএনপির অধিকাংশ নেতাই একাধিক পদে বহাল ছিলেন।
সর্বশেষ পরিস্থিতি হলো, দলের তৃণমূল নেতারা হাইকমান্ডের এ নির্দেশ মানলেও মানছেন না সিনিয়র নেতারা।
কাউন্সিলের আড়াই মাস পরও পদ ছাড়তে চাইছেন না একাধিক পদে থাকা শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতা।
২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বরের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে বিএনপির গঠনতন্ত্র সংশোধনী কমিটি মাঠ পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর সুপারিশে ‘এক নেতার এক পদ’ নীতির উদ্যোগ নেয়। তবে শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর সম্ভব হয়নি। কারণ, প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠের নেতৃত্বও নিজেদের ‘কব্জায়’ রাখতে দলের হাইকমান্ডকে নানা যুক্তি দিয়ে ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে দেননি। কিন্তু এবার দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল উপলক্ষে গঠনতন্ত্র সংশোধনীর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে এ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে দলের হাইকমান্ডের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করেন দলের তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় অনেক নেতা।
তখন স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতেই বিষয়টি নিয়ে স্থায়ী কমিটির তিন নেতার মধ্যে বাকবিতন্ডা হয়। পরিশেষে এক নেতা বাদে সবাই তখন এ বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন। সর্বশেষ খালেদা জিয়া এক নেতাকে একটি পদ দেওয়ার পক্ষে অটল থাকায় বিষয়টি আর বাধার মুখেও টেকেনি।
এক নেতার এক পদ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন সূচনা করছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি দুই পদ ছেড়ে দিয়েছেন। এপ্রিলের ৪ তারিখে দলের চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বরাবর কৃষক দলের সভাপতি ও ঠাকুরগাঁও জেলা বিএনপির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ পত্র জমা দেন তিনি।
এ ব্যাপারে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া বার বার তাগাদা দিলেও কোন নেতাই তার কথা আমলে নিচ্ছেন না। নবনির্বাচিত নেতারাও পাত্তা দিচ্ছেন না দলীয় প্রধানের এই নির্দেশ।
এদিকে নবনির্বাচিত সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহাবুব উদ্দিন খোকন, মুজিবুর রহমান সরোয়ার, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, হারুনুর রশীদ ও শাহ লায়ন আসলাম চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, ডা. শাহাদাত হোসেন, নজরুল ইসলাম মঞ্জু, অ্যাড. রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, বিলকিস শিরিন, আসাদুল হাবিব দুলু, ইমরান সালেহ প্রিন্স ও শামা ওবায়েদ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ,শফিকুল ইসলাম বাবুল, মাহবুবুর রহমান শামীম, আবুল হাশেম বক্কর, আব্দুল মমিন তালুকদার, শাহীন শওকত, অলিন্দ ইসলাম অরিক,জয়ন্তু কুমার কুন্ডু, অধ্যাপক আকন কুদ্দুসুর রহমান, মাহবুবুল হক নান্নু, দিলদার হোসেন সেলিম ,কলিম উদ্দিন মিলন, শামসুজ্জামান, জাহাঙ্গীর হোসেন, শরিফুল ইসলাম,ওয়ারেস আহমেদ আলী নেওয়াজ খৈয়ম, সেলিমুজ্জামান সেলিম, মোস্তাক হোসেন ,আব্দুল আউয়াল খানের নাম ঘোষণা করা হলেও তারা সংগঠনের অন্য পদগুলো এখনও ছাড়েননি।
অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে নতুন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। যুগ্ম মহাসচিবদের মধ্যে মজিবুর রহমান সরোয়ার বরিশাল মহানগর ও খায়রুল কবির খোকন নরসিংদী জেলার সভাপতি। আসলাম চৌধুরী চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক। হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। নতুন সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে ফজলুল হক মিলন গাজীপুর জেলা, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু নাটোর, আসাদুল হাবিব দুলু লালমনিরহাট ও নজরুল ইসলাম মঞ্জু খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি পদে রয়েছেন। ডা. শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রাম মহানগরের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের মধ্যে শুধু সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুবদল থেকে অব্যাহতি চেয়ে চিঠি দিয়েছেন।
এছাড়াও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ঢাকা মহানগর বিএনপির আহবায়ক, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকা মহানগর বিএনপিরও অন্যতম সদস্য, ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে রাবেয়া চৌধুরী কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা, আলতাফ হোসেন চৌধুরী পটুয়াখালী জেলা, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাদের মধ্যে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রাম মহানগর, শামসুজ্জামান দুদু চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিরও সাধারণ সম্পাদক।
আহমেদ আজম খান টাঙ্গাইল, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সিরাজগঞ্জ, অধ্যাপক মাজিদুল ইসলাম খুলনা জেলা, আবদুল মান্নান ঢাকা জেলা বিএনপি সভাপতির দায়িত্বে, শওকত মাহমুদ কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি।
আগের কমিটির যুগ্ম মহাসচিবদের মধ্যে আমানউল্লাহ আমান ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। তিনি একইসঙ্গে ঢাকা মহানগর বিএনপিরও সদস্য। মিজানুর রহমান মিনু রাজশাহী মহানগর বিএনপি সভাপতি। মোহাম্মদ শাজাহান নোয়াখালী জেলা বিএনপি সভাপতি। বরকত উল্লাহ বুলু ঢাকা মহানগর বিএনপিরও সদস্য।
এক নেতার এক পদের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে দলের নব-নির্বাচিত যুগ্ম-মহাসচিব এবং বরিশাল মহানগর সভাপতি মজিবুর রহমান সারোয়ার বলেন, দলের স্বার্থে কেন্দ্রীয় পদ রেখে তার জেলা সভাপতির পদ ছাড়া ঠিক হবে না। এতে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তার দুই পদে থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, নেতৃত্ব বিকাশের জন্য এক নেতার এক পদের উদ্যোগটি ভালো। তবে মহানগরগুলোতে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হতে সময় প্রয়োজন।
তবে এক নেতার এক পদ ঘোষণা হওয়ায় বেশীর ভাগ জেলা বা উপজেলায় দলটির স্থানীয় পর্যায়ে শীর্ষ পদে থাকা নেতারা কেন্দ্রের চেয়ে স্থানীয় পদের দিকেই ঝুঁকছেন বেশি। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য, কেন্দ্রে থাকলে জেলা পর্যায়ে মূল্যায়ন কম হয় এই ভয়ে কেন্দ্রের পদ চাইছেন না তারা। এখন স্থানীয় প্রভাব ধরে রাখতেই শীর্ষ ওই নেতারা দৌড়ঝাঁপ করছেন ।
এ প্রসঙ্গে খুলনা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল আলম মনা বিবার্তাকে বলেন, কেন্দ্র থেকে আমার মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। আমি বলেছি, কেন্দ্রে আমার পদের দরকার নেই। আমরা খুলনাতে স্থানীয়ভাবেই রাজনীতি করতে চাই।
মহাসচিব ছাড়াও ইতিমধ্যে বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টু, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জয়নাল আবদীন ফারুক কুমিল্লা বিভাগের নবনির্বাচিত সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আউয়াল খান একের অধিক পদ ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
এক নেতার এক পদ কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিবার্তাকে বলেন, এক নেতার এক পদ পার্টি যদি চায় তাহলে এটাতো কার্যকর হবেই। হয়ত শতভাগ সম্ভব হবে না। যদি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশও কার্যকর হয় পরবর্তীতে তা পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করবে। এখন অনেকে কেন্দ্র এবং জেলা দুই জায়গাই দখল করে রেখেছে। জেলা বা থানা পর্যায়ে অনেকে সেকেন্ড লিডারশীপ সৃষ্টি হতে দেয় না বা নাই, হয়ত সে অজুহাতে অনেকে দু’পদে থেকে যেতে পারে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে এটা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা সম্ভব না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন সম্ভব। তবে এখানে একটা সমস্যা হচ্ছে জেলায় নতুন কমিটি না হলে অনেকে পদ ছাড়তে পারছে না। আর যদি জেলার পদ এখনই ছেড়ে দেয় তাহলে সেই নেতার কেন্দ্রে অন্তর্ভূক্তির নিশ্চয়তা কে দেবে ?
বিবার্তা/বিপ্লব/মৌসুমী