সামাজিক কর্মসূচিতে আগের মতো অনুদান দিচ্ছে না দাতা সংস্থাগুলো। ফলে বিপাকে পড়েছে বিদেশী সহায়তানির্ভর বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) কার্যক্রম। প্রতিশ্রুত অর্থছাড়ের পরিমাণও কমে গেছে। আবার তহবিল কমে যাওয়ায় প্রকল্পের সংখ্যাও কমছে।
সংকট মোকাবিলায় এনজিওগুলোকে স্বঅর্থায়নের তাগিদ দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর ফিবছর এ খাতের বিস্তৃতি হলেও চলতি বছরে সামনে এসেছে একাধিক চ্যালেঞ্জ। বলা হচ্ছে শরণার্থী সংকট এবং বৈশ্বিক সংঘাতের কারণে আগামীতে কমতে পারে অনুদানের পরিমাণ।
এনজিও ব্যুরো সূত্রে জানা যায়, কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রকল্পের পরিমাণ অর্ধেকে নেমে গেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক হাজার ৩৫টি প্রকল্পের বিপরীতে অনুদান দেয়া হয়। কিন্তু এই অর্থবছরে মাত্র ৮০৫টি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি অনুদান কমেছে এক হাজার কোটি টাকার বেশি। এ সময় দাতা সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুত পাঁচ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকার বিপরীতে ছাড় করেছে চার হাজার ৪৯২ কোটি টাকা।
এ প্রসঙ্গে ইন্সস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্সের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. বাকী খলিলী বিবার্তাকে বলেন, বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার কর্মকাণ্ডে অস্বচ্ছতা, কর্মসূচি পরিবর্তন, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে দারিদ্র্যবিমোচন ও অভিবাসনখাতে দাতাদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়া, যুদ্ধসংঘাতের কারণে সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অনুদান প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ভাগে অনুদান কম পড়ছে। পাশাপাশি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই দাতারা এ দেশে অর্থায়নে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। আর অনেক এনজিওরই কার্যক্রমের কোনো স্বচ্ছতা নেই। এদেশের মানব উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন ও গবেষণাসহ বিভিন্ন কাজের নামে বিদেশ থেকে টাকা এনে নিজেরাই ইচ্ছেমতো খরচ করে।
এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অন্যদের থেকে ভালো ছিল বলে বিদেশীরা এদেশের বিভিন্ন এনজিওতে কাজ করেন। মূলত এদেশের উন্নয়নের নামেই বিদেশী দাতা এনজিওগুলোকে টাকা দেয়। কিন্তু বর্তমানের প্রেক্ষাপটে বিদেশীরা এদেশের এনজিও ছেড়ে অন্য দেশে চলে যেতে পারে। অনেক এনজিওর বিষয়ে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে। এতে সরকারের অগ্রগতি পিছিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
এনজিও ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে প্রকল্প ছিল এক হাজার ৪৬২টি। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল এক হাজার ৪৮টি, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছিল এক হাজার ১১৬টি, সর্বশেষ ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা নেমেছে এক হাজার ৩৫টিতে। আর চলতি বছরের প্রকল্প সংখ্যা এখনো হাজার অতিক্রম করেনি। তবে তাতেও বেশিরভাগ আগে নেয়া প্রকল্প। আট বছরে প্রকল্প কমেছে ৬৫৭টি।
ব্যুরোর সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানান, অর্থবছরের শেষদিকে আরো প্রকল্প অনুমোদিত হতে পারে। তবে অনুমোদনের এ হার আগের চেয়ে অনেক কম। আগের অনুমোদিত প্রকল্পের বিপরীতে বিভিন্ন বছরে অর্থছাড় হচ্ছে।
এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর বিগত ৫ অর্থবছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১০-২০১১ অর্থবছরে দেশে এক হাজার ১২০টি প্রকল্পের অধীন দেশে টাকা এসেছিল চার হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। ওই সময় দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তার প্রতিশ্রুতি ছিল পাঁচ হাজার ৮০ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে বিদেশি অনুদান এসেছিল চার হাজার ৩৪৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এ সময় প্রকল্পের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৭৭টি। তবে দাতাদের প্রতিশ্রুতি ছিল সাত হাজার ৪৪ কোটি ২০ লাখ টাকা সহায়তার।
তবে ২০১২-১৩ অর্থবছরে দাতা সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি টাকা অনুদান হিসেবে দিয়েছিল। ওই অনুদান আসে পাঁচ হাজার ৮১ কোটি ৩৫ লাখ টাকার। এ সময় দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতি ছিল চার হাজার ৭৯৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।
এরপর ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছয় হাজার ৩০৪ কোটি টাকা প্রতিশ্রুতির বিপরীতে অনুদান আসে পাঁচ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। তবে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রতিশ্রুতির বেশি টাকা অনুদান এসেছে। কিন্তু ওই অর্থবছরে অনুমোদিত প্রকল্পের পরিমাণ কমেছে। এ সময় দাতা সংস্থার প্রতিশ্রুতি ছিল চার হাজার ৯৮ কোটি টাকা। এক হাজার ৩৫টি প্রকল্পের বিপরীতে অনুদান এসেছে পাঁচ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা।
এনজিও খাতে বৈদেশিক সহায়তা দেখভাল করতে ১৯৯০ সালে কার্যক্রম শুরু করে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। দেশের মধ্যে বিদেশি সহায়তা নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হলে এই সংস্থা থেকে নিবন্ধন নেয়া বাধ্যতামূলক। ১৯৯০ সালে এনজিও ব্যুরো প্রতিষ্ঠার পর চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ২৭ বছরে মোট ৬০ হাজার ৭৯৪ কোটি টাকার অনুদান এসেছে। মোট ২৩ হাজার ৩৬টি প্রকল্পের অনুকূলে দাতা সংস্থা এ অর্থছাড় করেছে।
বিবার্তা/ মৌসুমী/জিয়া