‘রোজার আগের দিন ঢাকায় আইছি, রোজার মাসে মাইনসে দান-খয়রাত বেশি করে, তাই প্রতি বছর রোজার মাসেই ঢাকায় আহি। প্রতিদিন চার-পাঁচশর মত পাই। বাড়িত যাইয়া ভিক্ষা করি না, ক্ষেতের কাজ করি। ২৭ রোজার পরে বাড়ি চলে যামু। গত বছর রোজার মধ্যে ১০ হাজার টাকা কাউরান বাজার থেকে হিরনসিরা চুরি করে নিয়ে গেছে। পরে ১৫ দিনের মতো কাজ কইরা ছয় হাজার টাকার মতো জমাইয়া বাড়িতে নিয়া যাই।’
রাজধানীর হাইকোর্ট মাজারে কুড়িগ্রাম থেকে আসা আবুল হোসেন নামের এক ভিক্ষুক বললেন এসব কথা। জানা গেছে, তার মতো এরকম হাজার হাজার মৌসুমি ভিক্ষুক এই রমজানে ঢাকায় আসে। আবার রমজানকেন্দ্রিক মৌসুমি ভিক্ষুকের আলাদা সিন্ডিকেটও রয়েছে।
সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীতে প্রতিদিন প্রায় ৬০টি গুরুত্বপূর্ণ স্পটে ভিক্ষুকেরা ভিক্ষা করে। তবে মৌসুমি ভিক্ষুকের কারণে রমজান মাসে তা আরও বাড়তে পারে । সব মিলিয়ে রমজান মাসজুড়ে প্রতিদিন রাজধানীতে অন্তত পাঁচ কোটি টাকারও বেশি ভিক্ষাবাণিজ্য হয়ে থাকে ।
মৌসুমি ভিক্ষুক আবুল হোসেন বলেন, আমার ছেলে নাই। এক মেয়ে। তাকে বিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু প্যারালাইসিস হওয়ার পর জামাই তাকে ছেড়ে চলে গেছে। সে অন্য জায়গায় আরেকটা বিয়া করেছে, জামাই কোনো খাওন খরচ দেয় না। তাই আমাকেই মেয়ের দেখাশুনা করতে হয়।
আরেক ভিক্ষুক সিরাজগঞ্জের দেলোয়ার হোসেন বলেন, আমার বাড়িঘর নাই, সব নদীতে ভাইঙ্গা নিয়া গেছে। এখন নদীতে যে কাঢাল, কাঢাল বোঝেনতো..? (স্রোত) ঐ জায়গায় আমার বাড়ি। আমার একটা ছেলে একটা মেয়ে আছে। মেয়েটারে দুর্ভোগের মধ্যেই বিয়ে দিছি। অভাবে পরে ভিক্ষা করি, অভাব বোঝেনতো ..? কিছু নাই, যার টাকা পয়সা কম। ছেলেঢারে মেট্রিক পাস করাইছি। ও এখন গ্রামে কাপড়ের ব্যবসা করে আমারে প্রতিদিনে এক-দেড়শ টাকা দেয়, তাতে আমার হয় না। চিন্তা করলাম ঢাকায় যাই, রোজার মাসে কিছু টাকাপয়সা কামাই করে দেশে যাইয়া একটা ব্যবসা করুম।
তিনি আরও বলেন, আমার কাছে যদি ৪-৫ হাজার টাকা থাকতো তাইলে কারো কাছে হাত পাত্তাম না।
এদের মতো আরো অনেক ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভিক্ষা করে প্রত্যেকেই দৈনিক আয় করছেন পাচঁশ টাকারও বেশি । সেই হিসেবে পুরো রমজান মাসে ভিক্ষা করে তাদের এক একজনের গড়ে আয় হবে ১৫-২০ হাজার টাকা।
আবদুল ওহাব নামের এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ভিক্ষুক জানান, রমজানে মানুষের মধ্যে দানখয়রাতের প্রবণতা বেশি থাকে। এ সুযোগ হারাতে চান না তিনি। তাই রমজানের শুরুতেই রাজধানীতে চলে এসেছেন।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন বয়সের আরো অনেক ভিক্ষুক ট্রেন, লঞ্চ বা বাসযোগে ঢাকায় আসতে শুরু করেছে। অনেকে আবার এসেছে রমজানের আগেই অর্থাৎ শবে-বরাতে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার রমযান ও ঈদ উপলক্ষে ঢাকায় আগত মৌসুমি ভিক্ষুকের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
সূত্রে আরো জানা গেছে, সারা দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। এর মধ্যে ঢাকাতেই নিয়মিত ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। কিন্তু রমজান ও ঈদ উপলক্ষে মৌসুমি ভিক্ষুক আসায় রাজধানীতে এই সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়ে যায়। এই ভিক্ষুকরা বিশেষ করে রাজধানীর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, হাইকোর্ট মাজার, গুলশান আজাদ মসজিদ, মোহাম্মদপুরের আল হাসনা করিম ও শিয়া মসজিদ, মিরপুর শাহ আলী জামে মসজিদ, জুরাইন কবরস্থান, আজিমপুর কবরস্থান এলাকাকে ভিক্ষা করার জন্য বেছে নেয়।
এছাড়াও ফার্মগেট, নিউমার্কেট, হাইকোর্ট মাজার, শাহবাগ, বনানী কবরস্থান, গুলশান ১ ও ২ নম্বর, কাকরাইল মসজিদ, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, গোলাপশাহ মাজার, গুলিস্তান, সোনারগাঁও, শান্তিনগর, ইস্টার্ন প্লাজা, মগবাজার, মৌচাক, বসুন্ধরা শপিং মল, নিউমার্কেট, মৌচাকসহ গুরুত্বপূর্ণ শপিংমল এবং সায়েদাবাদ, গাবতলী, কমলাপুর রেল স্টেশন, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ইত্যাদি এলাকায় মৌসুমি ভিক্ষুকদের ভিড় দেখা যায়। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাদের ভিক্ষাবৃত্তি। এদের মধ্যেই অনেকেই কৃত্রিমভাবে বিকলাঙ্গতা প্রদর্শন করে ভিক্ষা করে থাকে।
বিবার্তা/আলী/মৌসুমী/হুমায়ুন