জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) প্রকাশ্যে ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্য কার্যক্রম না থাকলেও ছদ্মবেশে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠনটি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর (বাম) একটি সংগঠনের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একজন নেতার ছত্রছায়ায় থেকে সংগঠনটি নিজেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। এমনকী নিজেদের আসল পরিচয় ঢাকতে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে শিবির বিরোধিতার কৌশলও নিয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ‘রংধনু মেধাবিকাশে সহায়ক ফোরাম’, ‘স্পার্ক কোচিংসহ’ বিভিন্ন নামে দেশের প্রায় সব-ক’টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাচ্ছে ছাত্রশিবির। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব সংগঠনের পরিচালনা ও প্রশাসনিক পরিষদের দায়িত্বে রয়েছেন ফজলুর রহমান ও সুজন আব্দুল্লাহ নামে শিবিরের দুই সদস্য। এসব সংগঠনে শিবিরের সাথী ও সদস্য ছাড়া কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
জবিতে শিবিরকর্মীদের গোপন কর্মকাণ্ড এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সংগঠনটির একটি বৈঠকের ছবি রয়েছে এ প্রতিবেদকের কাছে।
সংগঠন দু’টির কার্যক্রম অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এর অধিকাংশ সদস্যই নীলফামারীর গোলনা মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। এর মধ্যে জবির ‘রংধনু : মেধা বিকাশে সহায়ক ফোরামে’র দায়িত্বে রয়েছেন নাজমুল হুদা, লিমন ইসলাম, ফজলুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, হাসনা হেনা রুপসা, আশিকুর রহমান, আলমগীর হোসেন ও রিফাত আলম রাজ। এদের মধ্যে নাজমুল হুদা আটক হয়েছিলেন, ২০১৫ সালের ২৫ মে তার জামিন হয়। এর আগের দিন ২৪ মে আশিকুর রহমান শিবিরের সাথী হন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ফজলুর রহমান জবির ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থী। পুরান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজ সংলগ্ন এলাকায় তিনি শিবিরের একটি মেস পরিচালনা করেন। এছাড়া রিফাত আলম রাজ জবির সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী।
এর মধ্যে গোলনা মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষার্থী রাজ জবিতে শিবিরের প্রচার বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের সাথী হুমায়ুন কবীর জীবন ও তুরস্কের শিবিরকর্মী লাবিব ফয়সালের সাথে বিভিন্ন ইস্যুতে শিবিরের সাংগঠনিক অবস্থান নিয়ে তার আলাপের তথ্যও এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
জানা গেছে, হুমায়ুন কবীর জীবন শিবিরের সাথী হলেও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রইউনিয়নের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। ২০১৪ সালের নভেম্বরে Lawless limon jnu নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির বিরুদ্ধে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়া হয়েছিল। এরপর জীবন জবি শিবিরের নেতা সুজন আব্দুল্লাহকে বলেন, ‘সময় আসার আগেই জবাব দিতে হবে।’ এর প্রমাণও এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জবি শিবিরের সব ধরনের কর্মকাণ্ডের ‘চ্যানেল’ হিসেবে রিফাত আলম রাজকে ব্যবহার করছে সংগঠনটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রচার বিভাগ ছেড়ে তাকে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব নিতেও বলা হয় সংগঠনটি থেকে। নীলফামারীর গোলনার জামায়াতে ইসলামীর আমির আজিজুল ইসলামের সঙ্গেও তার যোগাযোগ রয়েছে।
জানা যায়, গত এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মীর মোশারেফ হোসেনের (রাজীব মীর) বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে তাকে বাঁচানোর জন্য নতুন ইস্যু তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় শিবির। সে অনুযায়ী রিফাত আলম রাজ সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (একাংশ) সভাপতি মুজাহিদ অনিকের সাথে যোগাযোগ করে। প্রাথমিকভাবে কী ধরনের ইস্যুতে আন্দোলন করা যায় তা বুঝছেন না বলে তাকে জানান অনিক। পরে রাজ তাকে লাইব্রেরি ইস্যুতে আন্দোলন করতে বলেন। পাশাপাশি পরামর্শ দেন, ইস্যুটি যেন রাজীব মীরের ইস্যুকে চাপা দেয়। অনিকও তাতে সায় দেন।
পরবর্তী সময়ে ছাত্রফ্রন্টকে লাইব্রেরী ইস্যুতে আন্দোলন করতে দেখা যায়। সেসময় অনিক দেশীয় অস্ত্র নিয়ে লাইব্রেরীর দেয়াল ভাঙচুরে অংশ নেন।
জবি শিবিরের আরেক নেতা সুজন আব্দুল্লাহ ফেসবুকে ‘আমি মুসলিম, আমি আত্নসমর্পণকারী’নামের একটি গ্রুপে এবং ‘মুসাফির’নামের একটি পেজ থেকে বিভিন্ন সময় সরকারবিরোধী উস্কানিমূলক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। জবি শিবিরের আরেক নেতা ফজলুর রহমান ‘জলঢাকা নীলফামারী’নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে ছদ্মনামে শিবিরের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, এর প্রমাণও এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
শিবিরের এসব নেতার আলোচনায় শিবিরবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ‘চিহ্নিত’করার বিষয়টিও উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু সালেহ সেকান্দারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে ফেসবুকে দেয়া একটি পোস্টের জবাব দিতে রিফাত আলম রাজ ওইসময় সুজন আব্দুল্লাহর সহযোগিতাও চান।
আবার অন্যদিকে প্রকাশ্যে শিবিরবিরোধিতা ও সরকারের প্রশংসা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন, সাংবাদিক ও বিভিন্ন দপ্তরের সাথে যোগসাজশ করতেও দেখা যায় এসব শিবির কর্মীকে। এর মধ্যে রিফাত আলম রাজ একাধিক শিবির নেতাকে জানিয়েছেন, গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করার জন্য তিনি কিছু উল্টাপাল্টা কাজ করছেন।
এখানে উল্লেখ্য, রিফাত আলম রাজকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাম ব্যবহার করতে দেখা গেছে । নামগুলো হলো অপু রহমান, রিফাত আলম, রাজ, লাজু ইত্যাদি।
বিবার্তা/আদনান/মৌসুমী/হুমায়ুন