নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বজরার শাহী মসজিদ। দিল্লির শাহী মসজিদের অনুকরণে ১৭৪১ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। ফলে স্বভাবতই মসজিদটি মোগল স্থাপত্যের সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে। একসময় হাজারও পর্যটকের দেখা মিলতো এ বজরায়। প্রতিদিনের পর্যটকরা দেখতে আসতেন।
জানা যায়, ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে নোয়াখালীর ভুলুয়া দ্বীপাঞ্চলে কিছু সংখ্যক মুসলমান ধর্মীয় যোদ্ধা সুফি সাধকের আগমন ঘটে। বজরা নামক নৌযানে করে সমুদ্রপথে দিল্লি থেকে বর্তমান বজরা নামক স্থানে আগমন করেন। সেখানে বালুস্তরে তাদের নৌকা আটকে গেলে ওখানে নৌযান নোঙর করে তারা প্রথম নামাজ পড়েন। সেই স্থানেই পরে বজরা শাহী মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাদের বজরা নৌযানের নামেই অঞ্চলটির নাম বজরা রাখা হয়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সেই মুসলিম ধর্মীয় যোদ্ধা ও সুফি সাধকদের মধ্যে মিয়া অম্বর শাহের ব্যক্তিত্ব, নেতৃত্ব, ধর্মীয় একাগ্রতা, ত্যাগ, নিষ্ঠা, সাহসিকতা, সততা, ন্যায়নীতি ও মানব প্রেমে অভিভুত হয়ে বজরা অঞ্চলে ওমরাবাদ পরগণায় (পূর্বে দাদরা ওমরাবাদ) ইসলাম ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ঘটে।
ওমরাবাদ জমিদার পরিবারের সন্তান জমিদার আমানউল্যাহ খান দিল্লি দেওবন্দ মাদরাসা শিক্ষা শেষে দেশে ফিরে নিজ পরগনার জমিদার বাড়ির দরজার সামনে প্রায় ১৬ একর ভূমির উপর মগ সম্প্রদায় দ্বারা একটি বিশাল দীঘি খনন করেন। দীঘির পশ্চিম-দক্ষিণ সুউচ্চ পাড়ে ১৭৪১ খ্রিস্টাব্দে মুঘল প্রতিষ্ঠিত ভারতের দিল্লি শাহী জামে মসজিদের হুবহু অনুকরণে বজরা শাহী জামে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।
২০ ফুট মাটির নিচ থেকে গাঁথুনি দিয়ে সম্পূর্ণ চুন সুরকিতে তৈরি সুদৃশ্য তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদের দৈর্ঘ্য ১১৬ ফুট, প্রস্থ ৭৪ ফুট এবং উচ্চতা মাটির উপর থেকে ২০ ফুট।
এর বিশেষত্ব হচ্ছে প্রথম প্রবেশ পথে একটি স্বাগত গেট। অভ্যন্তরের প্রবেশদ্বারে আরেকটি আকর্ষণীয় তোরণ। এর ভেতরে চারদিক দেয়াল ঘেরা মাঝখানে ফাঁকা। এর এক পাশে শায়িত আছেন জমিদার আমান উল্যা ও ভ্রাতা ছানাউল্যাহ এবং মহীয়সী মাতা বিবি মরিয়ম জমিদার।
মসজিদের ভেতরে ঢোকার জন্য তিনটি সুদৃশ্য ধনুকাকৃতির প্রবেশ পথ। সামনে পূর্ব দিকে বিশাল খোলা প্রাঙ্গন অদূরে দীঘির পাড়ে বিশাল পাকা ঘাট এবং মসজিদের দক্ষিণ পাশে খালি জায়গায় রয়েছে জমিদার বংশের পারিবারিক কবরস্থান।
বজরা শাহী জামে মসজিদের প্রধান আকর্ষণ, এর ভবনের ছাদ, পার্শ্ব পাদদেশ বাইরে এবং ভেতরে আকর্ষণীয় মূল্যবান মার্বেল পাথরে আচ্ছাদিত এবং নানান কারুকাজ ও আরবি-ফারসি ভাষায় প্রস্তর শিলালিপি খচিত। দীর্ঘদিন থেকে এই মসজিদে শিরনিসহ নানা দান-মানত দিতে অনেকে আসতো। মুসলিম ধর্মীয় পরিবারে রোগমুক্তি শান্তি সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে হাজার হাজার দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ভিড় করতো এখানে।
বজরা শাহী মসজিদের পশ্চিমে অবস্থিত ওমরাবাদ পরগনার জমিদার বাড়ি। জমিদার বাড়ির দরজার সেই ঐতিহাসিক কাছারি ঘর যা আজও স্থানীয় বজরা ইউনিয়নের তহসিল অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। তহসিল অফিসের পশ্চিম পাশেই রয়েছে জমিদারদের বাড়ির অতি পুরনো একটি ভাঙা টয়লেট।
তহসিল অফিসের সাবেক কর্মকর্তা মাস্টার আবদুর রাজ্জাক (৮১) জানান, প্রয়াত জমিদার আমানউল্যাহ, নেয়ামত উল্যাহ মোট জমিদারির ১০ আনা এবং নবাব ফয়েজের নেছা ৬ আনা মালিক ছিলেন। বাড়ির আয়তন ছিল পাঁচ একর। বৃটিশ আমলে জমিদারি হস্তান্তর হলে তারা কুমিল্লা থেকে খাজনা আদায় করতে আসতেন এখানে। ১৯৫৩ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে ১৯৫৬ সালের দিকে স্থায়ীভাবে ওমরাবাদ পরগনার জমিদারগণ কুমিল্লায় চলে যান।
কুমিল্লায় নবাব ফয়েজুন্নেছা কলেজ, দক্ষিণ চরতা মুন্সি বাড়ি ও সাহাব বাড়ি গার্লস স্কুল, ওমরাবাদ বংশের জমিদারদেরই প্রতিষ্ঠিত বলে জানান তিনি।
বজরা শাহী জামে মসজিদের সম্মুখস্থ দীঘির উত্তর পাড়ে মুসলিম ধর্মীয় সুফি সাধক মিয়াম্বর শাহের মাজার রয়েছে। মাজারের পাশে বর্তমানে মারকাযুল উলুম মিয়াম্বর কাওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া বর্তমান সোনাইমুড়ী উপজেলার অম্বরনগর গ্রামটি মিয়া অম্বর শাহের নামে নামকরণ করা হয়েছে। মিয়াশ্বর শাহের মাজারের দায়িত্বে আছেন সুফি নজীর আহাম্মদ।
মাদ্রারাসার সুপার মুফতি মমিন উল্যাহ জানান, স্থানীয় নবাবগঞ্জ বাজার নবাবী আমলে জমিদারদের হাতে প্রতিষ্ঠিত এবং বর্তমান বজরা হাসপাতাল জমিদারদের জমিদারি ইজারা ভূমির উপর প্রতিষ্ঠিত। এছাড়া নবাবগঞ্জ বাজারের উত্তর পাশে সোনাইমুড়ী চৌমুহনী সড়কের পাশে অতি প্রাচীনতম নবাবগঞ্জ মসজিদটিও জমিদার পরিবারের লোকদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলে তিনি জানান।
বিবার্তা/সুমন/নিশি