কোল্লাপাথর যাব ঠিক করলাম। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকের যুদ্ধে শহীদদের সমাধি রয়েছে। একত্রে এত বেশিসংখ্যক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি সম্ভবত আর অন্য কোথাও নেই। সালাম যোবায়ের ভাই সাংবাদিক মানুষ। তিনি কোল্লাপাথর সম্পর্কে ধারণা দিলেন। তার কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে আজিজ ভাইয়ের নেতৃত্বে সংগঠিত হতে বেশি সময় লাগল না।
আমি মুক্তিযোদ্ধা জসিম ভাই, সুমন হোসাইন, শাহ ইয়াসিন বাহাদুর, নিপু, চান্দু, পারভেজ, জাফর, ফেলু ভাই ও ইয়াকুব কামালসহ আরও অনেকে একটি গাড়ি ঠিক করলাম। সাংবাদিক মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবিবও আমাদের সঙ্গে প্রধান অতিথি হলেন। আমরা শহীদদের কবর দেখবো অতঃপর কবিতা পাঠের আসর হবে। এজন্য কোল্লাপাথর বিষয়ে কবিতা রচনা নিয়ে বিস্তর ভাবনা চিন্তা করে এক পর্যায়ে জাপানি চোকা টাইপ কবিতা লিখে রওয়ানা দিলাম।
ঢাকা হতে এম আর মঞ্জু, সিরাজুল ফরিদসহ আরও অনেকে যোগ দিল। আমরা নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাং রোড হতে গাড়িতে চড়ি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা হয়ে সীমান্তঘেরা কোল্লাপাথর সহজ রুট। আরও সহজে যাওয়ার ব্যাপার ছিল ট্রেনে। বাস রিজার্ভ করে ফেলেছি। কাজেই ট্রেনের কথা আর চলছে না। আজিজ ভাই জানান, আরও কিছু মেহমান নরসিংদীর রায়পুরা থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। কাজেই যেতে হবে সিলেট রোডে ভৈরব আশুগঞ্জ দিয়ে। চললাম এ পথেই।
বাংলাদেশ যে সবুজ প্রকৃতিময় দেশ, এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় এসে তা হাতেনাতে টের পেলাম। যেদিকে তাকাই সবুজ আর সবুজ। সদ্য গজিয়ে ওঠা ধানক্ষেত মায়াময় দৃষ্টি দিয়ে যেন তাকিয়ে আছে। ধানের চারাগুলো হাতে ছুঁয়ে আদর করতে ইচ্ছে জাগে। কবি ইয়াকুব কামাল তো টিকতে না পেরে এক কবিতাই রচনা করে ফেলল। ড্রাইভারশন জটিলতায় গাড়ি থামলে অনেকেই ধান ক্ষেতের আইলে চলে যায়।
আমরা যে রাস্তা ধরে যাচ্ছি তার দু’পাশেও গাছের সারি। বিকাল তিনটা নাগাদ পৌঁছে যাই কোল্লাপাথর। কোল্লাপাথর নামটি নিয়ে আমাদের মধ্যে খটকা ছিল। আমি ভেবেছিলাম নামটি হবে কল্লাপাথর। নয়তো কুল্লাপাথর। যে ব্যানারটি করা হয়েছে তাতে লেখা হয়েছে কুল্লাপাথর। সেখানে গিয়ে দেখলাম, নামটি কোল্লাপাথর।
আমি এখানে আসার আগে ধারণা করেছিলাম পাহাড়ের ঢালে ঢালে সাধারণ অবস্থায় শহীদদের করবগুলো পড়ে আছে। না সেরকম নেই। একটি ছোট পাহাড়। পাহাড় না বলে বড় একটি টিলা বললে যথার্থ হয়। এই টিলাজুড়ে ফলইন করে কবরগুলো দেয়া হয়েছে। কবর সবই ইট দিয়ে বাঁধানো। যাতে নামফলক লাগানো আছে। একটা নাম দেখলাম ঢাকার আর কে মিশন রোডের ঠিকানা। বরিশাল, কুমিল্লা এমনি আরও অনেক জেলার লোক এখানে সমাহিত রয়েছে। এখানে ৪৯টি করব রয়েছে। কে জানে, শীহদদের সব পরিবার তাদের খবর জানে কিনা।
কোল্লাপাথর এসে খুবই ভালো লাগছে। জায়গাটি সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। চমৎকার একটি বাংলো নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলোটির কক্ষে কক্ষে মুক্তিযোদ্ধের সময়কার দুর্লভ কিছু ছবি টাঙ্গানো আছে।
কোল্লাপাথরে এসে জেনে খুবই আনন্দিত হলাম যে স্থানীয় এক সাধারণ (তিনি অবশ্য আমার কাছে অত্যন্ত অসাধারণ) মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম সাহেব কোল্লাপাথর এবং আশপাশে যারা শহীদ হয়েছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের উদ্ধার করে সমাহিত করার ব্যবস্থা করেন। নিজের টিলাটিও মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধির জন্য দান করেছেন। আবদুল করিমের প্রতি কৃতজ্ঞাতায় বুক ভরে গেল। আমরা কবর দেখার সময় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দোয়ার পাশাপাশি গাজী মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিম এবং তার পরিবারের প্রতিও মঙ্গল কামনা করি। ইচ্ছে ছিল তার সঙ্গে দেখা করার। হয়নি, তিনি ঢাকায় চলে এসেছিলেন।
সমাধি পরিদর্শন শেষে বিনোদনের জন্য এলাকাটি ঘুরে দেখার ইচ্ছা হল। বিশেষ ইচ্ছেটির কথাটি বলিনি। শুনে এসেছি সমাধিস্থল হল একেবারে সীমান্ত এলাকায়। সীমান্ত দেখার প্রবল বাসনা। বেরিয়ে পড়লাম। ছিমছাম পাকা রাস্তা পাহাড়ের ঢাল এগিয়ে গেছে। মানুষজন না থাকলে কি হবে পটহোলসবিহীন পাকা রাস্তা ঠিকই আছে। এটা আমার কাছে রহস্যময় ঠেকেছে।
যা হোক, গেলাম সীমানা পিলার পর্যন্ত। কাঁটাতারের ভেড়া সীমানা পিলারের ১৫০ গজ ফারাক। কাঁটাতারের বেড়া পর্যন্ত যাওয়া যায় না। নিষেধ আছে। এরকম নির্দেশনা সংবলিত সাইনবোর্ড নানা স্থানে টাঙ্গানো। তা আমি ভালোভাবে পড়ে নিয়েছি। অনেক দিনের শখ পূরণ হল। সীমানা পিলার ছুঁয়ে দেখলাম।
নিকটের পাহাড়গুলো ঘুরে দেখলাম। গাছগাছালিতে ভরপুর সেই যে বলেছিলাম সবুজময় বাংলাদেশ। এখানে এলে তা সর্বাঙ্গে অনুভব করা যায়। শহুরে জীবনের ক্লান্তি কাটাতে এরকম জায়গাগুলো খুঁজে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। যেমন আজ কোল্লাপাথর এলাম। আবার যাব অন্য কোথাও।
কিভাবে যাবেন: ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে ষ্টেশন থেকে আন্তঃ নগর ট্রেন যোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে এসে লোকাল ট্রেনে সালদা নদী ষ্টেশনে নেমে হেঁটে অথবা রিক্সায় কুল্লাপাথর আসবেন। অথবা ঢাকার সায়দাবাদ থেকে ঢাকা - কুটি বাসে (যমুনা) কসবা উপজেলার কুটি নামবেন। এখান থেকে বাসে কসবা এবং কসবা থেকে নারায়নপুরের বাসে কৈখলা নেমে রিক্সায় (৩ কিমি যাবেন রাতে যাবার জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ভালমানের হোটেল পাবেন। ফিরে আসার সময় ২ জন বীর বিক্রম, ১ জন বীর উত্তম ও ২ জন বীর প্রতিকসহ ৪৯ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি। আপনাকে পিছু ডাকবে।
বিবার্তা/জিয়া