সময়টা ছিল জানুয়ারির শেষ দিক, শীত তখনও রয়ে গেছে। বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। মোটামুটি স্থির, কক্সবাজার যাব। ঠিক তখনই এক বন্ধু বলল, ‘কক্সবাজার তো অনেকবার গিয়েছিস, এবার মহেশখালী ঘুরে আয়।’ ছোটবেলায় একটা সিনেমার পোস্টার দেখেছিলাম, নাম ‘মহেশখালীর বাঁকে’। নামটা প্রায়ই কানে বাজত।
তাই বন্ধুর কথায় পরিকল্পনা বদলে ফেললাম। কক্সবাজার যাব ঠিকই, তার আগে যাব মহেশখালী। সেখানে আমার আত্মীয় আছে, ফলে থাকা-খাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না।
ছোটবেলায় শুনেছি ছোট একটা চ্যানেল (বঙ্গোপসাগরের সরু একটা খাঁড়ি, যা মহেশখালী নদী নামেই পরিচিত) পাড়ি দিয়ে যেতে হয় মহেশখালী। বর্ষায় নাকি সেই চ্যানেলে ভয়ঙ্কর ঢেউ ওঠে, ট্রলার বা স্পিডবোটে ‘জান’ হাতে নিয়ে পাড়ি দিতে হয় চ্যানেল। কথাটা আংশিক সত্য।
মহেশখালী যাওয়ার পথ দুটি; সড়কপথে চকরিয়া থেকে বদরখালী হয়ে মহেশখালী অথবা কক্সবাজার থেকে ট্রলার বা স্পিডবোটে মহেশখালী। এর মধ্যে সড়কপথে বদরখালীতে নদীর মতো চ্যানেলের ওপর সেতু তৈরি হয়ে গেছে। ফলে এই পথ দিয়ে আর নৌপথ পাড়ি দেওয়ার দরকার নেই। কক্সবাজার থেকে ট্রলার বা স্পিডবোটে যেতে চাইলে বর্ষাকালে ঠিকই পথ ‘ভয়ঙ্কর’ হয়ে ওঠে। কারণ আবহাওয়া প্রায়ই থাকে দুর্যোগপূর্ণ। তবে শীতকালে ভয়ের কোনো কারণই নেই, সমুদ্র মোহনার এই চ্যানেল থাকে শান্ত।
আমি যাচ্ছি ঢাকা থেকে। তাই সড়কপথই বেছে নিলাম। ঢাকা-কক্সবাজারের বাসে চকরিয়া নেমে সেখান থেকে মহেশখালীর বাস ধরব। চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট থেকে মহেশখালী সরাসরি বাস যায়, তবে সেগুলো খুব একটা আরামদায়ক নয় বলেই কক্সবাজারের বাসে যাত্রা। অবশ্য চকরিয়া নেমে আবার সেই চট্টগ্রাম-মহেশখালীর বাসই ধরতে হবে। তবে সেখানে পথ কম, ঘণ্টাখানেকেই মহেশখালী পৌঁছানো যাবে।
ছোট এক উপজেলা শহর মহেশখালী। বেশ কর্মব্যস্ত। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত দ্বীপের দক্ষিণ দিকটায় বড় বাজার, উপজেলা কমপ্লেক্স, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কলেজ-হাইস্কুল ইত্যাদি। এদিকটাতেই আছে জেটিঘাট, যেখান থেকে কক্সবাজারের ট্রলার বা স্পিডবোটগুলো যাতায়াত করে। মূল মহেশখালী দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে ছোট খাঁড়ি দিয়ে ভাগ করা আরেকটি দ্বীপ, যার উত্তরের কর্মব্যস্ত অঞ্চল মাতাবাড়ি আর দক্ষিণে ধলঘাটা।
সাগর সৈকতে ঘুরে বেড়াতে এই ছোট দ্বীপটাই আদর্শ। সোনাদিয়া দ্বীপটি এখনও মূলত জেলেপল্লী, সাগর থেকে ধরে আনা মাছ শুঁটকি করতে সৈকতে শুকাতে দেয় জেলেরা। মহেশখালী থেকে সোনাদিয়া যাওয়া-আসার নিয়মিত কোনো যাত্রীবাহী নৌযান সার্ভিস নেই। স্পিডবোট ভাড়া করে সেখান থেকে ঘুরে আসতে হবে। ঘণ্টাদুয়েকের জন্য স্পিডবোট ভাড়া নেয় ৭-৮শ টাকা।
পুরো মহেশখালীতে আছে ছোট ছোট টিলা, যেগুলো মূলত বন বিভাগের তৈরি করা সেগুন-গর্জনের বনভূমি। মহেশখালীর এসব বনভূমি আর সাগর সৈকত ছাড়াও এর অন্যতম দুই প্রধান আকর্ষণ হিন্দুদের আদিনাথ মন্দির ও বৌদ্ধদের প্যাগোডা। এ দুটি না দেখে মহেশখালী বেড়ানই বৃথা।
উপজেলা শহর মহেশখালীতে ছোট ছোট কয়েকটি হোটেল আছে। অবশ্য মান নিয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না। এছাড়াও থাকার জন্য আছে সরকারি রেস্টহাউস, স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে সেখানে থাকা যায়। চাইলে রাত না কাটিয়েও মহেশখালী ঘুরে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে সড়কপথে না গিয়ে কক্সবাজার গিয়ে সেখানকার জেটিঘাট থেকে স্পিডবোটে মহেশখালী যেতে পারেন।
মাথাপিছু ভাড়া নেবে ৭০ থেকে ৮০ টাকা, সময় লাগবে মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিট। সারা দিন মহেশখালী-সোনাদিয়া দ্বীপ ঘুরে সন্ধ্যায় আবার কক্সবাজার ফিরে আসতে পারবেন। অবশ্য যেমনটি আগে বলছিলাম, এই বর্ষাকালে কক্সবাজার-মহেশখালী চওড়া চ্যানেলটি অনেকটাই বিপজ্জনক। যারা আগে কক্সবাজার গিয়ে সেখান থেকে মহেশখালী যেতে চান অথচ বঙ্গোপসাগরের চ্যানেলও পাড়ি দিতে ভয় পান, তারা কক্সবাজার থেকে চকরিয়া হয়ে মহেশখালী যেতে পারেন। তবে এই পথে দিনে দিনে মহেশখালী বেড়িয়ে আসার পরিকল্পনা না করাই ভালো।
বিবার্তা/জিয়া