৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা পৃথিবীর বৃহত্তম বনাঞ্চল আমাজন। সেখানে যেমন আছে বৃক্ষের সৌন্দর্য, তেমনি আছে নানা ভয়ও। সেই ভয়কে জয় করে অনেকে আমাজনে যান। তেমনই এক অভিযাত্রীর রোমাঞ্চকর ভ্রমণকথা বিদেশী সাময়িকী থেকে অনুবাদ করেছেন হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
আমাজনের জঙ্গলে ঝপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো। আমি বসে আছি একটি ডোঙা নৌকায়, যাকে স্থানীয় লোকজন বলে ‘কানু’। নৌকায় বসে আমি সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করলাম। সূর্য অস্ত যেতেই নদীর পানি কফির রঙ ধারণ করল। আমাজন জঙ্গলে ৯৫০ প্রজাতির বাদুড় আছে। তারই এক প্রজাতির কিছু সদস্যকে দেখা গেল আঁধার নামতেই তৎপর হয়ে উঠেছে। আরো দেখা গেল ‘বানর মাছ’। পানি থেকে লাফ দিয়ে পোকা ধরার দক্ষতার জন্যই এই নামকরণ। আমার চোখের সামনেই একটি বানর মাছ পানি থেকে লাফ দিয়ে উঠে অপূর্ব দক্ষতায় একটি ফড়িং ধরে ফের পানিতে মিলিয়ে গেল।
এসব দেখতে দেখতেই আবছা আঁধার ঘনিয়ে এলো, যেন কেউ নদী ও জঙ্গলের মাথার ওপর কালো পর্দা বিছিয়ে দিয়েছে। অরণ্যের হাজার হাজার গাছের সবুজ ছায়া গেল কালো হয়ে। এরই মধ্যে দেখি, নদীর পাড়ের দিক থেকে রহস্যময় লাল আলোর ফুটকি যেন আমাদের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। ব্যাপারখানা কী, বোঝার জন্যই আমি টর্চ জ্বালালাম।
এবার মুখ খুললেন এনরিক সানচেজ। তিনি আমার গাইড। অতিবিখ্যাত গাইড তিনি। বললেন, ‘ওগুলো হলো কাইমানের চোখ। কাইমান হলো আমাদের অ্যালিগেটর (এক প্রজাতির কুমির)।’আমি টর্চের আলোয় দেখলাম, গোটা ছয় কাইমান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে আছে। সানচেজ বললেন, ‘এ জন্যই বলেছিলাম, রাতের বেলায় নদীতে গোসল করা বা সাঁতার কাটা ঠিক নয়। এই কাইমানগুলোর পেটে সবসময় ক্ষুধার আগুন জ্বলে।’
প্রিয় পাঠক, এবার নিজের কথা বলি। অন্য অনেক পর্যটকের মতো আমিও আমাজন অরণ্যে এসেছি অ্যাডভেঞ্চার করতে। সত্যি বলতে কী, গত সপ্তাহখানেকের ঘোরাঘুরিতে এই অরণ্য আমাকে নিরাশ করেনি। আমি ট্যাক্সি, নৌকা, বাস ও কানুতে চড়ে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছি। ব্রাজিলের আমাজন নদী-তীরবর্তী শহর মনোউসের দক্ষিণে নদীতে মাছ ধরেছি, রাক্ষুসে মাছ পিরানহার সাথে সাঁতার কেটেছি। আমি দেখতে চেয়েছি এ অঞ্চলের পৌরাণিক কাহিনীর সেই গোলাপি ডলফিন ও বিশাল অ্যানাকোন্ডাকে (দেখিনি একটাও), তিন আঙুলবিশিষ্ট শ্লথ ও পাহাড়ি শুয়রকে (দেখেছি অল্প ক’টা), রঙিন টাউকান ও টিয়া পাখিকে (অনেক দেখেছি)। আমি দেখতে গিয়েছি স্থানীয় রিবারিনহোদের। যারা মাটিতে বাড়িঘর বানায় না, বাস করে পানির ওপর।
আমি দেখেছি আমাজনের আদি বাসিন্দা উড়ন্ত মাকড়সা, যার একটি কামড়ই একজন মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। দেখেছি বড় বড় জোঁক, দেখলে মনে হয় বুঝি ছোট একটা সাপ। দেখেছি নানা জাতের বিচ্ছু এবং বুলেট পিঁপড়া (এদের একটি কামড়ে যে ক্ষত হয়, তা বুলেটের ক্ষতের মতোই, তাই এই নাম), দেখেছি রক্তচোষা বাদুড়, যার আকৃতি আমার মুখমণ্ডলের সমান। দেখেছি ইলেকট্রিক ইল মাছ। কাইমানের কথা তো আগেই বলেছি। আর দেখেছি ঝাঁকে ঝাঁকে মশা, যারা বহন করছে হলুদ জ্বর, ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণু। মশা আছে সবখানে ঘরে, বাইরে, নদীতে ও জঙ্গলে।
বনে-জঙ্গলে টিকে থাকতে হলে কী কী করতে হবে, আমার গাইড সানচেজ (৫৯) সে পাঠটি আমাকে ভালোভাবে দিয়েছিলেন। দেখিয়েছিলেন প্রায় সময় ভেজা ভেজা থাকা অরণ্যে কিভাবে আগুন জ্বালাতে হয়। কিভাবে অস্থায়ী ঝুপড়ি বানাতে হয়। হাতে তৈরি বর্শা দিয়ে কিভাবে মাছ শিকার করতে হয় এবং সাদা কাচপোকা ধরে খেতে হয়। ওতে নাকি খুবই প্রোটিন আছে। সানচেজ আমাকে বুঝিয়ে দেন : ‘ধরেই মাথাটি ছিঁড়ে ফেলে দেবে, বাকিটা খেয়ে ফেলবে।’
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে প্রতিদিনই আমরা বেড়াতে বের হতাম। সন্ধ্যা নামার আগেই ফিরে আসতাম নদীতীরে আমাদের ইকো-লজে। রাতটা সেখানেই কাটত; আরামে ও নিরাপদে। এক দিন ঠিক হলো, পরদিন বের হবো, কিন্তু ফিরব না। রাতে বনেই ক্যাম্প করব এবং ঘুরে কাটাব। বনের গভীরে দু’টি গাছের ডালে ডালে জোড়া দিয়ে পাতা হবে আমাদের দোলনা বিছানা। সব কিছু হবে সভ্যতার শেষ চিহ্নটিরও কয়েক কিলোমিটার দূরে। সব ঠিকঠাক করে, রাতের খাবার খেয়ে আমরা বের হবো নৈশকালীন বন পর্যটনে। এভাবেই শেষ হবে আমার সপ্তাহব্যাপী অ্যাডভেঞ্চার।
পরদিন বিকেলে আমি ও সানচেজ সব কিছু গোছগাছ করে নিলাম। সবকিছু বলতে কয়েকটি হ্যামক (দোলনা বিছানা) একটি মাছ ধরার বর্শা, এক ব্যাগ চাল, পানির কয়েকটি ক্যানটিন, কফি, বাটি, মশা মারার ওষুধ ইত্যাদি। সব কিছু নিয়ে আমরা মেমারি নদীতে নৌকায় চড়ে বসলাম। এবার আমাদের সঙ্গী হলেন আরো একজন রেনেটো কাসকাস। এই স্থানীয় মৎস্যজীবী মানুষটি এ অঞ্চলের অন্ধিসন্ধি ভালোমতেই চেনেন।
আমরা যখন আমাদের ক্যাম্প এলাকায় পৌঁছেছি, তখন সূর্যের আলো ফিকে হয়ে এসেছে। মশা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ উড়তে শুরু করেছে। ম্লান আলোয় অরণ্যকে দেখাচ্ছে অন্ধকার, ঘন, এমনকি আদিম। দিনের আলোয় যেমন দেখেছিলাম, তার চেয়ে একেবারে ভিন্ন। তার সাথে শুরু হলো নানা রকম শব্দ। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আমাজন রেইনফরেস্টে আড়াই লাখ প্রজাতির কীটপতঙ্গের বসত। আমার মনে হলো, ওদের সবাই বুঝি গলা চড়িয়ে একযোগে ডাকতে শুরু করেছে।
ততক্ষণে রেনেটো তার হাতের দা দিয়ে গাছের একটি শুকনো ডাল কাটতে শুরু করেছেন। এই ডালটি দিয়েই পরে আগুন জ্বালানো হবে। আর সানচেজ ও আমি ভাত রান্নার জোগাড়যন্ত্র করছি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আগুন জ্বলে উঠল। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল চার পাশ। আগুনের চার পাশের জঙ্গল হয়ে গেল আরো কালো অন্ধকারে আবৃত।
অরণ্যের অন্ধকার দেখতে দেখতে আমি ভাবছিলাম, এই গহিন অরণ্যে আজকের নৈশযাপন কতটা নিরাপদ হবে। এ সময় হঠাৎ, আমি যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে ১০ মিটারের মতো দূরে, একটা তীব্র শব্দ শুনে চমকে উঠলাম। সানচেজ বললেন, ‘এটা মনে হয় বাঁশ-ইঁদুর। ভয় নেই, কামড়ায় না। রাতের বেলা আশ্রয়ের খোঁজে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করে। বুঝলে, আমরা জঙ্গলের প্রাণী দেখতে এসেছি। কিন্তু দেখো, পাশার দান কেমন উল্টে গেছে! এখন ওরাই আমাদের দেখছে।’
সানচেজের কথা শুনতে শুনতে আমি কল্পনায় দেখতে থাকলাম আমাজনের সব হিংস্র প্রাণী কিভাবে আমাদের দেখছে জাগুয়ার, বিষাক্ত মাকড়সা থেকে শুরু করে অ্যানাকোন্ডা, সবই। তারা আমাদের দেখছে। দেখছেই।
আমি সানচেজকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই জঙ্গলে জাগুয়ার (বিড়ালজাতীয় মাংসাশী প্রাণী) আছে?’
‘আছে। তবে খুব কম।’ জানালেন সানচেজ।
‘চিতাবাঘ আছে?’
‘আরো কম।’
‘সাপ? সাপ তো নিশ্চয়ই আছে।’জানতে চাই আমি। সাপকে আমার খুব ভয়। সবচেয়ে বেশি ভয় পিট ভাইপারকে। এ সাপের একটি ছোবলেই মৃত্যু নিশ্চিত। এর ছোবলে আমাজনে প্রতি বছর কমবেশি ১০০ লোকের মৃত্যু হয়। আমাজন অরণ্যের গভীরে সাপের বসবাস বেশি। আমরাও তো অরণ্যের গভীরেই আছি আজ। আর সাপের চলাফেরা শুরু হয় রাতে। এখন তো রাতই।
আমার প্রশ্নের জবাবে সানচেজ বলেন, ‘হ্যাঁ, সাপ তো আছেই।’বলেই হাতের ৬০ মিটার লম্বা দা-টি দেখান, ‘আমাদেরও এটি আছে।’
‘আমি সানচেজের কাছে জানতে চাই তিনি কাউকে পিট ভাইপার সাপে কাটতে দেখেছেন কি না। সানচেজ বলেন, ‘হ্যাঁ, দেখেছি।’
দেখারই কথা। আমাজন জঙ্গলে তিনি গাইডের কাজ করলেন ৩০ বছর হলো। এরকম দু-চারটা দুর্ঘটনা তিনি দেখবেন না, তা কি হয়? সানচেজ বলেন, ‘ও ছিল আমাদের খুব ভালো বন্ধু। ওকে সুরুচুচু সাপে কেটেছিল। তিন মিটার লম্বা সাপটি গাছের ডাল জড়িয়ে ছিল। মাটি থেকে দেড় মিটার মাত্র ওপরে। আমাদের বন্ধুটি যেই না ওই গাছের নিচ দিয়ে যাচ্ছিল, অমনি সাপটি ওর ঘাড়ে দাঁত বসায়।’
কথা শেষ করে সানচেজ সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকান। বলেন, ‘তারপর সে মরে গেল। খুব খারাপ লাগে। তবে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। খুব বেশি কষ্ট পায়নি সে, তাড়াতাড়িই মরে গেছে।’
রাত ১০টা নাগাদ আমরা রাতের খানা খেলাম। নদী থেকে পিরারুচু নামে এক জাতের মাছ ধরেছিল রেনেটো। সেই ঝলসানো মাছের সাথে গরম ভাত বেশ মজা করেই খেলাম। এরপর অবশ্য ক্যাম্পের আরাম এবং জ্বলন্ত আগুনের নিরাপত্তা ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে হবে বনপথে - ঘণ্টাব্যাপী নৈশ পর্যটনে।
বেরোনোর আগমুহূর্তে আমি আবার, একটু দ্বিধা নিয়ে অবশ্য, প্রশ্নটা করি সানচেজকে : ‘আচ্ছা, আমাদের চলার পথে সাপ পড়বে না তো?’
সানচেজ জবাব দেন, ‘পড়তে পারে। তবে আমরা হুঁশিয়ার থাকব। আর শোন, তুমি সাপকে যেমন ভয় পাচ্ছ, সাপ তোমাকে তার চেয়ে বেশি ভয় পায়, বুঝলে?’ বলেই সানচেজ তার প্যান্টের বাম পা গোটান আর বিষধর ক্যাসকাবেল সাপে কাটার দাগ দেখান। তার ডান হাতের মধ্যমায়ও রয়েছে আরেকটি ক্ষতচিহ্ন। এটি জারারাকা সাপে কেটেছিল। এটিও বিষধর পিট ভাইপার। সানচেজ বলেন, ‘দুবারই ডাক্তার আমাকে ইনজেকশন নিতে বলেছিল। আমি নিইনি।’বলে মৃদু হাসেন সানচেজ, ‘ভয় পেয়ো না। আজ রাতে আমাদের কিছু হবে না।’
কিছু যে হবে না, তা তো শুনলাম এবং বুঝলামও। কিন্তু বুকের কাঁপুনি যে থামে না! কাঁপতে-কাঁপতেই দুই গাইডের সাথে বনের পথে বেরিয়ে পড়লাম। আমার সামনে রেনেটো। তার পায়ে রাবারের জুতা, যাতে সাপে কাটতে না পারে। সেই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে। আমার পেছনে সানচেজ। দু’গাইডই তাদের হাতের লম্বা দা দিয়ে ডালপালা কেটে কেটে পথ করে সামনে চলেছেন। আমার হয়েছে বিপদ। যেই না কোনো গাছের ডাল নিচু হয়ে সামনে পথ আগলে দাঁড়ায়, ভয় হয় ওই বুঝি সেখান থেকে বিষধর সাপ কিংবা ব্যাঙ বা মাকড়সা এসে আমাকে কেটে দিলো। ফলে আমাদের পথচলা ছিল মন্থর। তা ছাড়া মাটিতে গাছের মরা ডালপালা এবং নানা লতাগুল্মও আমাদের পদে পদে বাধা দিচ্ছিল।
ঘন বনের মধ্যে পথ চলতে চলতে আমরা ততটুকুই দেখছিলাম যত দূর পর্যন্ত আমাদের টর্চের আলো পৌঁছাচ্ছিল। টর্চের আলোটা যেন একটা সুড়ঙ্গ, আমরা তার ভেতর দিয়ে পথ চলছি। এর বাইরে সীমাহীন অন্ধকার। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি।
আমাদের টর্চের আলো বুঝি আকর্ষণ করছিল মশা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গকে। তারা তীব্র বেগে ছুটে আসছিল আলোর পানে। তাদের সংখ্যা এত বেশি, আমাকে ওই কীটপতঙ্গকে হাত দিয়ে সরিয়ে পথ চলতে হচ্ছিল।
বনের ভেতরের বাতাস স্যাঁতস্যাঁতে, আর্দ্রতায় ভরা আর অক্সিজেনে বোঝাই। আমি লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে বুকের ভেতর টেনে নিচ্ছিলাম সেই অক্সিজেন। বাতাসের স্বাদ ছিল মিষ্টি এবং যেখানে গাছপালা কমে এসেছে সেখানে ঈষৎ কটু। অরণ্যে জন্ম-মৃত্যু দুটো পাশাপাশি চলছে। গাছপালা মরেও যাচ্ছে, আবার জন্মও নিচ্ছে। এখানকার মাটি এতই উর্বর যে, ছয় মাসের মধ্যেই তা ফের বৃক্ষলতাগুল্মে ভরে ওঠে।
পথ চলতে চলতে আমরা দেখা পেলাম এক অজগরের। মনে মনে চমকে উঠলাম। তবে সেই ভয় কাটার আগেই অদ্ভুত এক আওয়াজ শুনে পিলে চমকে উঠল। আওয়াজ তো নয় যেন বিমানের ইঞ্জিন চালুর শব্দ অথবা কোনো হরর মুভির সাউন্ডট্র্যাক। শব্দটা আমাদের খুব কাছে কোথাও থেকে আসছিল।
আমি যে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি, সেটা যথাসম্ভব লুকানোর চেষ্টা করে সানচেজকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিসের শব্দ ওটা?’
‘হাউলার বানর’, মৃদু হেসে জবাব দিলেন সানচেজ। বললেন, ‘ওটা এখান থেকে কমসে কম তিন কিলোমিটার দূরে তো হবেই।’
পরে আমি জেনেছিলাম, মাটির ওপর চলাফেরা করে এমন প্রাণীদের মধ্যে এদের আওয়াজই সবচেয়ে চড়া। বাব্বাহ, এদের ভোকাল চেম্বার বুঝি পাথরে তৈরি!
এ দিকে কয়েক মিনিট পরপরই দেখি রেনেটো হঠাৎ থেমে যাচ্ছে এবং কিছু বুঝতে পেরেছে এমন ভঙ্গিতে মাথা দোলাচ্ছে। সানচেজ তা দেখে আমার কানে কানে বলেন, ‘জন্তু-জানোয়ারের শব্দ শুনছে।’
সানচেজ মাঝে মাঝেই টর্চ জ্বালিয়ে আমাকে এটা-ওটা দেখান কয়েক শ’ফুট উঁচু গাছের গুঁড়ি, বর্ণিল মাকড়সা, মিলিটারি পিঁপড়ার দলের সারি বেঁধে এগিয়ে চলা। সবই দেখি, কিন্তু কোনো কথা বলি না। আমাদের যেন পথ চলাতেই আনন্দ।
আমার দু’গাইড সানচেজ ও রেনেটো নীরবে পথ চলছেন। এমন সাবধানে পা ফেলছেন যেন বনের কোনো প্রাণী বিরক্ত না হয় বা চমকে না যায়, বিশেষ করে সেসব প্রাণী যারা আমাদের ক্ষতি করতে পারে। আমার মনে পড়ল আমাজন সম্বন্ধে পড়া ক’টি লাইন : ‘এই অরণ্যের জীবন্ত সব কিছুই আক্রমণে প্রস্তুত; হয় ক্ষতি করতে নয়তো আত্মরক্ষার জন্য।’
এ সময় হঠাৎ আমার দিকে ফিরলেন সানচেজ, ‘গন্ধ পাচ্ছ?’ ফিসফিস করে বললেন, ‘একটি অ্যানাকোন্ডা এখানে তার খোলস ছেড়েছে। আমি তার গন্ধ পাচ্ছি।’
ভয় আমাকে জেঁকে ধরল। আমি পথ চলছিলাম সানচেজের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এখানে কোনো বিষধর সাপ শুয়ে নেই তো! যদিও আমি জানি, মানুষের আগমনের কম্পন অনুভব করলেই সাপ সরে যায়, কিন্তু জানলে হবে কী, মনের ভেতর থেকে তিন মিটার লম্বা সাপের ছবিটা কিছুতেই সরাতে পারছিলাম না।
আমার বুক কেঁপেই চলছিল, যদিও রাতটা ছিল ঠাণ্ডা। আমি প্রতিটা পা ফেলার আগে টর্চের আলো ফেলে দেখছিলাম পথটা, আর মাথার ওপর গাছের ডালে কোনো সাপ ঝুলে আছে কি না। হঠাৎ মাটির ওপর দিয়েই চলে গেল একটি সাপ, আমার হাতের চেয়েও বড়।
হঠাৎ চলা থামিয়ে দিলেন আমার দু’গাইড। একেবারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। কী ব্যাপার! আমাদের বাম দিকে তিন মিটার দূরে পাতার ভেতর কী যেন নড়ছে। আমার বুক কেঁপে উঠল। সানচেজ বললেন, ‘মনে হয় সাপ ছিল ওটা। চলে গেছে।’
আমাদের বনপর্যটন ৩০ মিনিট হয়ে গেল। রেনেটো আবার চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি নীরবে হাত রাখলাম সানচেজের পিঠে : ‘অনেক কিছু দেখলাম। এবার মনে হয় ফেরা যেতে পারে।’
অন্ধকার রাত, ঘন বন, বন্যপ্রাণীর চিৎকার, ‘বন্যপ্রাণীরা আড়াল থেকে আমাদের দেখছে’এমন অনুভূতি এবং আরো নানা রকম কল্পনা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আমি নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছিলাম এবং যত দূর মনে পড়ে আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
আমরা ক্যাম্পে ফিরে এলাম। রেনেটো জ্বলন্ত আগুনে আরো কয়েকটি লাকড়ি ছুড়ে দিলেন। সানচেজ বললেন, ‘আমি জানি, তুমি ভয় পেয়েছ। তবে মনে রেখো, আমাজনের জঙ্গলে এটাই তোমার প্রথম রাত। ভয় তো পাবেই। প্রথম প্রথম আমাদেরও ভয় হতো। কিছু ভয় পাওয়া ভালো। আরো ভালো এই জঙ্গলকে ভালোবাসতে পারা।’
হ্যাঁ, এই অরণ্য। ৫৫ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা, রহস্য ও রোমাঞ্চভরা এই বৃষ্টিচ্ছায়া আমাজন অরণ্য, যাকে ঘিরে রচিত হয়েছে সংখ্যাহীন উপকথা একে ভালো না বেসে পারা যায়!
আমি হ্যামকে চড়ে বসলাম। মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে মশারি টানিয়ে নিলাম। কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে ভেসে আসছে হাউলার বানরের চিৎকার আর আশপাশি ব্যাঙ, পোকামাকড়, নিশাচর পাখি, বাদুড় এবং আরো অনেক কিছুর মিলিত সুরধ্বনি।
এত সব হৈ চৈয়ের মধ্যেও কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। পৃথিবীর অবশিষ্ট ক’টি সত্যিকার বনাঞ্চলের একটির ভেতরে; কম্বল মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুম।
বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী