চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি মনে গেঁথে থাকবে

চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি মনে গেঁথে থাকবে
প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০১৬, ০৮:৩০:৫৩
চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি মনে গেঁথে থাকবে
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+
পৃথিবীতে যুদ্ধ কারো কাম্য নয়, কিন্তু তারপরও দেশে দেশে যুদ্ধ হয়েছে যুদ্ধ হয়েছে পৃথিবী জুরে। যুদ্ধের বিভীষিকাময় স্মৃতি আর যুদ্ধে নিহত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাই গড়ে উঠেছে ইমারত, ভাস্কর্য। চট্টগ্রামের ওয়ার সিমেট্রি তেমনই এক স্মৃতিকথার গল্প বলে।
 
চট্টগ্রামের ওয়ার সিমেট্রি তৈরি করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈন্যদের সম্মানে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এটি প্রতিষ্ঠা করে। এই সিমেট্রিতে আছে ৪০০ টি সমাধি যার মধ্যে বেশীরভাগই ব্রিটিশ সৈন্যদের। এছাড়াও আছে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, অবিভক্ত ভারত এবং আফ্রিকার অনেক যোদ্ধার সমাধি।
 
জানা যায়, ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গভীর জলের পোতাশ্রয় চট্টগ্রাম এলাকা ছিল আরাকান সামরিক তৎপরতার অন্যতম ঘাঁটি ও উল্লেখযোগ্য চিকিৎসা কেন্দ্র বা হাসপাতাল। মূলত এই হাসপাতালে মৃত ব্যক্তিদের জন্য এ সমাধিস্থলটি সৃষ্ট করা হয়। প্রথমে দিকে এই সিমেট্রিতে ছিল ৪০০ সশস্ত্র সদস্যের সমাধিস্থল। বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ৭৩১ টিতে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়াও সমাধিস্থলের আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও যে কারো নজর কাড়ে।
 
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইন্দোবার্মা রণাঙ্গনে আজাদ হিন্দ ফৌজের আক্রমণে মিত্রবাহিনীর যেসব সৈন্য নিহত হন তাদের বেশির ভাগকে এদেশে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীকালে এসব সৈন্যের কবরস্থানকে ঘিরে গড়ে ওঠে আকর্ষণীয় ওয়ার সিমেট্রি।
চট্টগ্রাম ওয়ার সিমেট্রি মনে গেঁথে থাকবে
এরকম দুটি ওয়ার সিমেট্রির একটি রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগরীর বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়কে, অপরটি কুমিল্লার ময়নামতি। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি প্রতিবেশী পোল্যান্ড আক্রমণ করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। জার্মানির পক্ষে ছিল ইতালি, যুগোশ্লাভিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া ও জাপান (অক্ষশক্তি)। অপরদিকে পোল্যান্ড, ব্রিটেন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, রাশিয়া, আমেরিকা প্রভৃতি দেশ নিয়ে গড়ে ওঠে মিত্রবাহিনী।
 
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তীব্রতর হয়। তখন ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ শাসন করত। নেতাজী সুবাস বোস সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে ব্রিটেনের ঘোর শত্রু জামানি গিয়ে হিটলারের সাহায্য চেয়ে ব্যর্থ হয়ে জাপান চলে আসেন। রাসবিহারী বসু থেকে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। জাপান এবং প্রবাসী ভারতীয়দের সহযোগিতায় পুনর্গঠন করেন আজাদ হিন্দ ফৌজ।
 
আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অর্থের অভাব থাকলেও সুবাস বোসের অসাধারণ নেতৃত্বের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্যের একটি সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক সৈন্যদল গড়ে ওঠে। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা ১৯৪৫ সালের গোড়ার দিকে সর্বপ্রথম বার্মা দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যসমূহ আক্রমণ করে ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। সুবাস বোসের সরাসরি নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের আরাকান, ইম্ফল, ময়রাং, বিষেণপুর প্রভৃতি স্থান দখল করে নেয়।
 
ব্রিটেনের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনী দখলকৃত জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য বিমানের সাহায্য নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করে। ফলে আজাদ হিন্দ ফৌজ ছত্রভঙ্গ হয়ে রেঙ্গুনে এসে পুনর্গঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমেরিকা কর্তৃক জাপানে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ এবং এ কারণে জাপানের আত্মসমর্পণ ও নেতাজীর রহস্যজনক নিখোঁজ হওয়ায় আজাদ হিন্দ ফৌজ দুর্বল হয়ে পড়ে। কয়েক মাস স্থায়ী এ যুদ্ধে আজাদ হিন্দ ফৌজের পক্ষে ২৭ হাজার সৈন্যের মৃত্যু হয়।
 
মিত্রবাহিনীরও প্রায় চার হাজার সৈন্যের মৃত্যু হয়। মিত্রবাহিনীর এসব সৈন্যকে নিজ নিজ দেশে পাঠানো হয়। যাদের পাঠানো সম্ভব হয়নি তাদের চট্টগ্রামে এবং কুমিল্লায় সমাহিত করা হয়। পরে কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশন এ দুটি স্থানে আকর্ষণীয় ওয়ার সিমেট্রি গড়ে তোলে। তবে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য আজাদ হিন্দ ফৌজের যেসব সৈন্য শহীদ হন তাদের জন্য গড়ে ওঠেনি কোনো ওয়ার সিমেট্রি কিংবা স্মৃতিস্তম্ভ।
 
চট্টগ্রাম মহানগরীর মেহেদীবাগের বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়কের বাম পাশে রয়েছে এই ওয়ার সিমেট্রি। এর সামনের দিকটি লোহার উঁচু বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা। প্রায় ৪ একর জমির ওপর নির্মিত এই ওয়ার সিমেট্রির পরিবেশ অত্যন্ত আকর্ষণীয়। সামনের অংশটি নানাজাতের গাছগাছালিতে পূর্ণ। এরপরই রয়েছে মূল গেট। গেটের চারদিকে সবুজ লন। এর ঠিক মাঝখানে রয়েছে শ্বেতপাথরে নির্মিত ক্রুশাকৃতির স্মৃতিস্তম্ভ। এই স্তম্ভের একেবারে পেছনের দিকে রয়েছে সৈন্যদের কবর। এর সামনে রয়েছে সৈন্যদের স্মৃতিফলক।
 
প্রত্যেক স্মৃতিফলকে মৃত সৈন্যের নাম, বয়স, জাতীয়তা ও র্যাং ক পিতলের প্লেটে খোদাই করে লেখা আছে। এখানে সেনা ও বিমান বাহিনীর মোট ৭৫৫ সৈন্যের স্মৃতিফলক রয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ১২ এবং ২টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এই সিমেট্রি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। নিরিবিলি আর মনোরম পরিবেশ থাকায় প্রতিদিন অসংখ্য দর্শনার্থী এই ওয়ার সিমেট্রি দেখতে আসেন।
 
কিভাবে যাবেন: নগরীর জিইসি মোড় থেকে পূর্ব দিকে এগিয়ে গোল পাহাড়ের মোড় হয়ে ডান দিকে দেখা যাবে বাদশা মিয়া চৌধুরী সড়ক। এই সড়কে আনুমানিক ১০০ মিটার এগোলে হাতের ডান ধারে সরকারি চারুকলা ইন্সিটিউট। আর বাঁ পাশে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে রয়েছে ওয়ার সিমেট্রি।
 
খোলার সময়: ঈদের সময় ছাড়া বছরের বাকি দিনগুলোতে সকাল ৮:০০ টা থেকে দুপুর ১২:০০ টা এবং বেলা ২:০০ টা থেকে বিকাল ৫:০০ টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য সমাধিস্থলটি খোলা রাখা হয়। হুইল চেয়ারেও প্রবেশ করা যাবে মেইন গেট দিয়ে।
 
বিবার্তা/জিয়া
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com