বাংলাদেশ রূপ বৈচিত্রের দেশ। সারা দেশে রয়েছে ভ্রমণের জন্য অনেক রোমাঞ্চকর স্থান। যেখান থেকে ঘুরে এসে মনকে চাঙ্গা করতে পারেন। মনের ক্লান্তি দূর করে আবারো মনোযোগী হতে পারেন দৈনন্দিন কাজে। এমন একটি আকর্ষণীয় স্পট হচ্ছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর এই উদ্যান। চায়ের শহর শ্রীমঙ্গল থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ (কমলগঞ্জ) সড়কের পশ্চিম পাশে জাতীয় এ উদ্যানের প্রবেশপথ। বাংলাদেশের সাতটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও দশটি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে লাউয়াছড়া অন্যতম। চিরহরিৎ এ বনাঞ্চল বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের নিরাপদ আবাসস্থল। এছাড়াও নানান দুর্লভ জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ আর গাছপালার জন্য এ অরণ্য বিখ্যাত। সুন্দরবনের পরপরই পর্যটকদের কাছে বেশি জনপ্রিয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।
লাউয়াছড়া উদ্যানের পুরনো নাম পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যে এই বনের প্রায় ১,২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ, সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দেয়া হয়।
এই বনে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ বন্যপ্রাণী ও গাছপালা। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রজাতির উভচর, ছয় প্রজাতির সরিসৃপ, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী ও ২৪৬ প্রজাতির পাখি। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অন্যতম আকর্ষণ বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক। গভীর জঙ্গলের উঁচু ডালে এরা পরিবারসহ বসবাস করে। এ ছাড়া চশমা বানর, মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতী বানর, মেছো বাঘ, শিয়াল, মায়া হরিণ ইত্যাদিও দেখা যায় এ বনে।
এখানে আছে অজগরসহ নানারকম সাপ। এ ছাড়া হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপও এ বনের উল্লেখযোগ্য সরীসৃপ। পাখিদের মধ্যে আছে সবুজ ঘুঘু, বনমোরগ, হরিয়াল, তুর্কিবাজ, কালো মাথা টিয়া, লেজকাটা টিয়া, কালো ফর্কটেইল, ধূসর সাতশৈলী, কালো বাজ, হিরামন, কালো মাথা বুলবুল, ধুমকল, পেঁচা, ফিঙ্গে, সবুজ সুইচোরা, সবুজ কোকিল, ফিঙে, কেশরাজ ইত্যাদি।
বনের ভেতর দিয়েই বয়ে গেছে বেশ কয়েকটি পাহাড়ি ছড়া। তবে এসব ছড়াগুলোর বেশিরভাগই পানিতে পূর্ণ থাকে বর্ষাকালে। সামান্য যে কটি ছড়ায় শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে সেসব এলাকায় বন্যপ্রাণীদের আনাগোনা বেশি। প্রধান সড়ক ফেলে কিছুদূর চলার পরে ভেতর দিয়েই চলে গেছে ঢাকা-সিলেট রেললাইন। এর পরেই মূলত জঙ্গলের শুরু। মূল সড়ক ছেড়ে জঙ্গলের ভেতরে প্রবেশ করলে সাইরেনের মতো এক ধরনের শব্দ কানে আসে। এটি মূলত এ বনে থাকা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। উদ্যানে বেড়ানোর তিনটি পথ আছে। একটি তিন ঘণ্টার, একটি এক ঘণ্টার এবং অন্যটি আধ ঘণ্টার পথ। উদ্যানের ভেতরে একটি খাসিয়া পল্লীও আছে।
ভ্রমণের আধঘন্টার মধ্যে যা নজরে আসবে: এ পথটির শুরু রেললাইন পেরিয়ে হাতের বাঁ দিক থেকে। পথের শুরুতে উঁচু উঁচু গাছগুলোতে দেখা মিলতে পারে কুলু বানরের। নানারকম গাছ-গাছালির ভেতর দিয়ে তৈরি করা এ হাঁটা পথে চলতে চলতে জঙ্গলের নির্জনতায় শিহরিত হবেন যে কেউ। এ ছাড়া এ পথের বড় বড় গাছের ডালে দেখা মিলবে বুনো অর্কিড। নির্দেশিত পথে হাতের বাঁয়ে বাঁয়ে চলতে চলতে এই পথ আবার শেষ হবে ঠিক শুরুর স্থানে।
ভ্রমণের এক ঘন্টার মধ্যে যা নজরে আসবে: এক ঘণ্টার ট্রেকিংয়ের শুরুতেই দেখবেন বিশাল গন্ধরুই গাছ, যার আরেক নাম কস্তুরী। এগাছ থেকে নাকি সুগন্ধি তৈরি হয়। এপথে দেখবেন ঝাওয়া, জগডুমুর, মুলীবাঁশ, কাঠালীচাঁপা, লেহা প্রভৃতি গাছ। আরও আছে প্রায় শতবর্ষী চাপলিশ আর গামারি গাছ। পথের পাশে থাকা ডুমুর গাছের ফল খেতে আসে উল্লুক, বানর ও হনুমান ছাড়াও বনের বাসিন্দা আরও অনেক বন্যপ্রাণী। মায়া হরিণ আর বন মোরগেরও দেখা মিলতে পারে।
ভ্রমণের দুই ঘণ্টার মধ্যে যা নজরে আসবে: তিন ঘণ্টার হাঁটা পথটিও বেশ রোমাঞ্চকর। পথের বাঁয়ে খাসিয়াদের বসত মাগুরছড়া পুঞ্জি। এ পুঞ্জির বাসিন্দারা মূলত পান চাষ করে। পথে দেখা মিলবে বিশাল বাঁশ বাগান। বাগানে আছে কুলু বানর আর বিরল প্রজাতির লজ্জাবতী বানর। লজ্জাবতী বানর নিশাচর প্রাণী। এরা দিনের বেলায় বাঁশঝাড়ে ঘুমিয়ে কাটায়। রয়েছে নানান প্রজাতির পাখি। এ পথের শেষের দিকে দেখা মিলতে পারে বনের অন্যতম আকর্ষণ উল্লুক পরিবার। এরা বনের সবচেয়ে উঁচু গাছগুলোতে দলবদ্ধভাবে বাস করে।
ভ্রমণের উপযুক্ত সময়: প্রায় সারা বছরই ভ্রমণে যাওয়া যায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। তবে সাধারণ পর্যটকদের ভ্রমণের জন্য অক্টোবর থেকে মার্চ মাস ভালো সময়।
ভ্রমণের মাধ্যম: লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণে প্রথমে যেতে হবে চায়ের শহর শ্রীমঙ্গল। নিজস্ব গাড়ি নিয়ে গেলে সরাসরি লাউয়াছাড়া উদ্যানে চলে যাওয়া যায়। অন্যথায় শ্রীমঙ্গল থেকে অটো রিকশা, জীপ কিংবা গাড়ি ভাড়া করে যেতে হবে। ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়দাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাস যায় শ্রীমঙ্গল। ভাড়া সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা।
এছাড়া ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬.৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস, দুপুর ২.০০ মিনিটে প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০.০০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১১৫ থেকে ৭৬৫ টাকা। রেলপথে সাধারণত ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। এ ছাড়া চট্টগ্রাম রেলপথে সরাসরি শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮.১৫ মিনিটে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯.০০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া ২৩০ থেকে ৫৯৫ টাকা।
থাকার জন্য প্রয়োজনীয় রিসোর্টের তথ্য: লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশেই থাকার জন্য আছে লেমন গার্ডেন রিসোর্ট। এ রিসোর্টে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায় বিভিন্ন মানের কক্ষ আছে। যোগাযোগ: ০১৭৬৩৪৪৪০০০, ০১৭৫৮৭৭১৪৯২।
লাউয়াছড়ার কাছাকাছি আরও আছে ভানুগাছ সড়কে গ্রান্ড সুলতান গলফ রিসোর্ট। পাঁচ তারকা মানের এ রিসোর্ট ব্যয়বহুল। ঢাকায় যোগাযোগ করতে চাইলে: বাড়ি ১০৮, অ্যাপার্টমেন্ট এ-২, সড়ক ৮, ব্লক সি, বনানী, ঢাকা ১২১৩। ফোন: ০২-৯৮৫৮৮২৭, ০১৭৩০৭৯৩৫৫২-৭। ভানুগাছ সড়কে আরও আছে টি রিসোর্ট (০৮৬২৬-৭১২০৭, ০১৭১২৯১৬০০১)।
শ্রীমঙ্গলের অন্যান্য হোটেল হল হবিগঞ্জ সড়কে রেইন ফরেস্ট রিসোর্ট (০২-৯৫৫৩৫৭০, ০১৯৩৮৩০৫৭০৭) ও টি টাউন রেস্ট হাউস (০৮৬২৬-৭১০৬৫), কলেজ রোডে হোটেল পস্নাজা (০৮৬২৬-৭১৫২৫) ইত্যাদি।
এছাড়া শ্রীমঙ্গলের রাধানগরে চমৎকার দুটি রিসোর্ট হল নিসর্গ নীরব ইকো রিসোর্ট (০১৭১৫০৪১২০৭) এবং নিসর্গ লিচিবাড়ি ইকো রির্সোট (০১৭১৬৯৩৯৫৪০)।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের কাছাকাছি আরেকটি ভালো থাকার জায়গা কমলগঞ্জের সুইজ ভ্যালী রিসোর্ট। প্রকৃতির মাঝে সুন্দর সাজানো এ রিসোর্টে সময় কাটাতে ভালো লাগবে। শমশেরনগর বিমানবন্দরের পাশে অবস্থিত এ রিসোর্ট। কটেজগুলোতে ২ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকায় নানারকম কক্ষ আছে। যোগাযোগ: ০১৭৮৬৪৯৩৭০০।
প্রয়োজনীয় আরো কিছু তথ্য: লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ মূল্য প্রাপ্তবয়স্ক ২০ টাকা, ছাত্র ও অপ্রাপ্তবয়স্ক ১০ টাকা, বিদেশি নাগরিক পাঁচ মার্কিন ডলার কিংবা সমমূল্যের টাকা। এ ছাড়া গাড়ি, জীপ ও মাইক্রোবাস পার্কিং ২৫ টাকা। জঙ্গল ভ্রমণে কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা উচিত। উজ্জ্বল রংয়ের পোশাক পরে জঙ্গল ভ্রমণে যাওয়া উচিত নয়। বনে হৈচৈ করলে বন্যপ্রাণীদের দেখা যাবে না। তাই সর্বোচ্চ নিরবতা পালন করতে হবে। সঙ্গে নেয়া পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট বনের মধ্যে না ফেলে সঙ্গে এনে বাইরে ফেলা উচিৎ। ট্রেকিংয়ের সময় সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার পানি নিন। আইপ্যাকের প্রশিক্ষিত গাইড সঙ্গে নিয়ে ট্রেকিং এ যাওয়া উচিত। নয়তো পথ হারানোর ভয় আছে। বর্ষা মৌসুমে লাউয়াছড়া উদ্যানে জোঁকের উপদ্রব বাড়ে। এ সময় ভ্রমণে প্যান্ট মোজার মধ্যে গুঁজে নিন। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে জুতার উপরে গুল ছিটিয়ে নিতে পারেন।
বিবার্তা/জিয়া