নবী মুহাম্মদ সা. মানুষকে শুধু একাত্মবাদ ও ইবাদত বন্দেগীর প্রতিই উৎসাহ দেননি, ব্যবসা বাণিজ্য সামাজিক উন্নয়নের প্রতিও তিনি সমান গুরুত্ব দেন। মহানবীর সা. এর জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম ছিল ব্যবসা করা। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। মক্কা শহর আরব উপদ্বীপের মধ্যে বিশেষ ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
হজরত ইব্রাহিম আ. দোয়া করেছিলেন, ‘অতএব, হে আল্লাহ! আপনি লোকদের মনকে তাদের প্রতি আগ্রহী বানিয়ে দিন এবং তাদের রিজিক দিন নানা ধরনের ফলমূল দিয়ে, যেন তারা শোকর করতে পারে।’(সুরা ইব্রাহিম: ৩৭)। এ দোয়াও মক্কাবাসীর জন্য খুবই কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে।
মাত্র ১২ বছর বয়সে রাসূলুল্লাহ (সা.) চাচা আবু তালিবের সঙ্গে সিরিয়ার পথে একটি বাণিজ্যিক কাফেলায় অংশগ্রহণ করেন। পথিমধ্যে ‘বুহাইরা’নামক এক খ্রিস্টান পাদ্রির সঙ্গে দেখা হলে তিনি শিশু মোহাম্মদকে ইহুদিদের থেকে সাবধানে রাখার পরামর্শ দেন। তাই আবু তালিব দ্রুত তাকে নিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন।
যৌবনে উপনীত হওয়ার পর মেষ চরানো এবং পরে ব্যবসার মাধ্যমে শুরু হয় মহানবীর (সা.) অর্থনৈতিক জীবন। তাঁর ব্যবসায়িক সুনাম ও ‘আল-আমিন’ উপাধিতে ভূষিত হওয়ার কারণে খাদিজা (রা.) তাকে প্রথমত ব্যবসা ও দ্বিতীয়ত স্বামী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন।
হজরত খাদিজা (রা.) ছিলেন একজন ধনবতী, ভদ্র ও সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী মহিলা। তিনি তার পুঁজি দিয়ে লাভক্ষতির অংশীদারিত্বভিত্তিক যৌথ ব্যবসা করতেন। খাদিজা রা. মহানবীর সা. এর সততা ও উত্তম চরিত্রের কথা জানতে পেরে তাঁকে পুঁজি নিয়ে সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে যাওয়ার জন্য আবেদন জানালেন। মহানবী (সা.) তার প্রস্তাব গ্রহণ করলেন এবং দ্বিগুণ পুঁজি ও বিনিময় নিয়ে খাদিজার ক্রীতদাস ‘মায়সারাহ’র সঙ্গে সিরিয়ার পথে বাণিজ্যিক সফরে বের হলেন। বিগত সফরগুলোর তুলনায় এবার সফরে দ্বিগুণ লাভ হলো।
‘মায়সারাহ’ খাদিজার কাছে রাসুল (সা.) এর বিশ্বসত্মতা ও মহান চরিত্রের বর্ণনা দিলেন। খাদিজা (রা.) বিশেষত রাসুল (সা.) এর সংস্পর্শে আসার পর তার সম্পদে যে সমৃদ্ধির চিহ্ন ফুটে উঠেছে, তা দেখে তিনি বিস্মিত হলেন। তিনি তার বান্ধবী ‘নাফিসাহ’র মাধ্যমে রাসুল (সা.) এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন। রাসুল (সা.) এ ব্যাপারে তাঁর চাচাদের সঙ্গে মতবিনিময় করলে তারা বিয়ে সম্পন্ন করেন।
স্বামী হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা.) খাদিজার ব্যবসার তত্ত্বাবধান করতেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেও খাদিজার পুঁজি নিয়ে পুরোদমে ব্যবসা করছিলেন। তিনি ছিলেন বাণিজ্য নগরী মক্কার সর্বাধিক পুঁজিবান ব্যবসায়ী। নিঃসন্দেহে এ দীর্ঘ ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতাই তাঁর জন্য মদিনায় অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটাতে সহায়ক প্রমাণিত হয়েছিল।
রাসুলুল্লাহ (সা.) নবুয়তের আগে পার্টনারশিপের ব্যবসাও করেছেন। বর্ণনাভেদে তিনি আস সাইব ইবনে নুমায়লা অথবা তার বাবার সঙ্গে পার্টনারশিপের ব্যবসা করেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে সাইব বলেন, আমি জাহেলি যুগে রাসূলুল্লাহ সা. এর ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলাম। এরপর যখন মদিনায় পৌঁছলাম, তখন আমি রাসুলুল্লাহ সা. কে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে চিনতে পেরেছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনি আমার ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন, অত্যন্ত উত্তম পার্টনার, যে কোনোরূপ প্রতারণা করেনি আর বিবাদও করেনি।
রাসুলুল্লাহ সা. এর অনাড়ম্বর জীবনচরিত দেখে একথা ভুলে গেলে চলবে না, তিনি ছিলেন মক্কার সবচেয়ে বলিষ্ঠ, বুদ্ধিমান ও অধিক পুঁজিবান ব্যবসায়ী। নবী হওয়ার আগে তিনি মানবসেবায় নিজের পুঁজি কী পরিমাণ খরচ করতেন তা খাদিজার (রা.) ভাষায় ফুটে উঠেছে, ‘নিশ্চয় আপনি আত্মীয়তার বন্ধন রচনা করেন, মেহমানদারি করেন ও অনাথকে বহন করেন এবং নিঃস্বের জন্য উপার্জন করেন।’
অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত মুহাজিররা ছিলেন ভীষণ দুর্বল। কারণ তারা আপন ধনসম্পদ মাতৃভূমি মক্কায় রেখে এসেছিলেন। এ মুহূর্তে রাসুল (সা.) তাদের ও আনসারদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করে তাঁর অসীম প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। মুহাজিররা কৃষিকাজ জানতেন না। ব্যবসাই ছিল তাদের প্রধান অর্থনৈতিক অবলম্বন। তাই রাসুল (সা.) মসজিদ নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাজার প্রতিষ্ঠা করা শুরু করেছিলেন।
হিজরত ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন এবং তথায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অর্থনৈতিক কাঠামো রচনার পটভূমি। মক্কায় মুসলমানদের অর্থনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ ছিল না। সেখানে আবু বকর (রা.) এবং ধনী সাহাবিরা কোনো কোনো মুসলমানকে দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে তাদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করেছিলেন মাত্র।
খাদিজা (রা.) ও আবু বকর (রা.) এর মতো ধনী ব্যবসায়ীরাও অর্থনৈতিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছিলেন। হিজরতপূর্ব সময়ে তারা এক ধরনের নির্বাসনের পরিবেশেই জীবনযাপন করছিলেন। গোত্রে গোত্রে বিভেদই ছিল হিজরতের আগে মদিনার সার্বিক উন্নতির প্রধান অন্তরায়। এ ভ্রাতৃত্ব সব বিভেদের অবসান ঘটিয়ে এক নতুন সমাজ উপহার দিতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি উপহার দিয়েছিলেন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ এক উন্নত সমাজ।
বিবার্তা/জিয়া