উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে আমাদের নারীরা অন্তঃপুর বাসিনী হয়ে কাটানোর ইতিহাসই দীর্ঘ। মাঝে মাঝে যদিও দু-একজন প্রীতিলতা, বেগম রোকেয়ারা ব্যাতিক্রম ছিলেন। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনেও নারীদের অতি ক্ষুদ্র একটা অংশের অংশগ্রহন ছিল। কিন্তু, সেই চিত্রটা ১৯৭১ সালে এসে পুরোটাই বদলে যায়। প্রতিটি বাঙালি নারী যেন এক একজন প্রীতিলতা হয়ে উঠেছিলেন সে সময়।
মাটির টানে, দেশের টানে, সাত সমুদ্র আর তের নদীর ওপারে ব্রিটেনের নারীরাও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে জড়িয়েছিলেন। নেমে এসেছিলেন ব্রিটেনের রাজপথে। গঠন করেছিলেন ‘বাংলাদেশ উইমেন্স এসোসিয়েসন ইন গ্রেট ব্রিটে’। শুধু বাংলাদেশী না তাদের সাথে অনেক ভিনদেশি, ভিনভাষী নারীও যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে। বিদেশ-বিভুঁইয়ে কেমন ছিল তাদের সেই আন্দোলন।
বিলেতে বাংলার রাজনীতিতে মহিলাদের অংশ গ্রহণ খুব একটা উল্লেখযোগ্য না হলেও ১৯৬০-এর দশক থেকে পূর্ব বাংলাকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্দ্যেশ্যে গঠিত ‘বাংলা একাডেমি’ ইস্ট পাকিস্তান হাউজ ইত্যাদি সংগঠনের কর্মকাণ্ডে মহিলারাও জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন-রুকাইয়া কবীর, তালেয়া রহমান, বারবারা হক, রেজমেরী আহমদ (তাসাদ্দুক আহামেদের জার্মান স্ত্রী), মিসেস ডায়েন লাম্ব ( জাকারিয়া খান চৌধুরীর ইংরেজ স্ত্রী), রিজিয়া চৌধুরী, সুরাইয়া খানম, নোরা শরীফ ( সুলতান মাহমুদ শরীফের আইরিশ স্ত্রী) ও নুরুন্নেসা চৌধুরী।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন এবং পরবর্তীকালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় থেকে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং উৎসাহের সাথে মিটিং-মিছিলে সংক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করতে থাকেন। ফলে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই যুক্তরাজ্যবাসী বাঙালি রাজনীতি সচেতন নেতৃস্থানীয় মহিলারা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন এবং পরিস্তিতিকে সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের খবর পাওয়ার পরপরই তারাও পুরুষদের পাশাপাশি নিজেদের মতো করে সংগঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করেন মিসেস জেবুন্নিসা বখস ও ফেরদৌস রহমান। এরা দু’জন অন্যান্য নেতৃস্থানীয় মহিলার সাথে যোগাযোগ করে ২৮ মার্চ জেবুন্নিসা বখসের (১০৩ লেডবারি রোড, লন্ডন ডব্লিউ ১১) বাসায় একটি সভা আহ্বান করেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন বিলকিস বানু, সোফিয়া রহমান, ফেরদৌস রহমান, মিসেস জেবুন্নেসা বখস, হাসিনা চৌধুরী, শেফালী হক, মিসেস ফজিলাতুন্নেসা, নোরা শরীফ, মুন্নি রহমান, জ্যোৎস্না হাসান, কুলসুম উল্লাহ, সেলিনা, মোল্লাসহ আরও অনেকে।
১৯৮৯ সালে লন্ডনে দেয়া এক সাক্ষাতকারে ‘বাংলাদেশ উইমেন্স এসোসিয়েশন ইন গ্রেট ব্রিটেন’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মিসেস জেবুন্নিসা বখস বলেন, ২৫শে মার্চে আর্মি ক্রাকডাউনের আগে থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম দেশে ভয়ংকর একটা কিছু হতে যাচ্ছে। এদেশের খবরের কাগজে কিছু কিছু সংবাদ আসছিল। তাই আমরা মহিলাদের পক্ষ থেকে একটা কিছু করার কথা ভাবছিলাম। এরপর এলো ২৫শে মার্চের সেই ভয়াল রাত। আমরা বুঝলাম, আর নয়। অপেক্ষা করার দিন শেষ হয়ে গেছে। এবার রাস্তায় নামতে হবে। এর জন্য চাই একটা সংগঠন। আমরা আলাপ-আলোচনা করতে থাকলাম। অবশেষে ২রা এপ্রিল আমার বাড়িতে (১০৩ লেডবারি রোডে) মিসেস ফেরদৌস রহমান, ঊর্মি রহমান, লুলু বিলকিস বানু এবং আরো দুই একজন একত্র হলাম এবং সেদিনই আমাকে কনভেনার করে ‘বাংলাদেশ উইমেনস এসোসিয়েশন ইন গ্রেট ব্রিটেন’ (বাংলাদেশ মহিলা সমিতি) গঠিত হয়।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে প্রায় তিন মাস এটির সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন মিসেস সোফিয়া রহমান। জনসংযোগের দায়িত্ব পালন করেন ফেরদৌস রহমান, আনোয়ার জাহান ও মুন্নি রহমান। পরবর্তীকালে পারিবারিক অসুবিধার কারণে সোফিয়া রহমান সংগঠনের কার্যক্রম থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে জেবুন্নেসা বখস প্রেসিডেন্ট, আনোয়ারা জাহান সেক্রেটারি ও খালেদা উদ্দিন ট্রেজারার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মূলত, ‘বাংলাদেশ উইমেন্স এসোসিয়েসন ইন গ্রেট ব্রিটেন’-এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়েছিলো ৩ এপ্রিল শনিবার, টেমস নদীর তীরবর্তী চেরিংক্রস আমব্যাকমেন্ট এলাকা থেকে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশের মধ্যদিয়ে। এই সমাবেশকে সাফল্যমন্ডিত করার লক্ষ্যে জেবুন্নিসা বখস ফেরদৌস রহমান, আনোয়ার জাহান, সোফিয়া রহমান, মুন্নি রহমান, জেবুন্নিসা খায়ের, শেফালী হক, খালেদা উদ্দিন, পুষ্পিতা চৌধুরী ও সেলিনা মোল্লা প্রমূখের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ৩ এপ্রিল ব্রিটিশ মিডিয়া ও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য সব মহিলাকে শাড়ি পরে আসতে হবে। যাতে ব্রিটেনের মানুষের জিজ্ঞাস্য বিষয় হয়ে উঠে যে, রাজপথের বিক্ষোভকারী শাড়িপরা মহিলারা কি চায়?
সিদ্ধান্ত মোতাবেক ওই দিন বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কতৃক সংঘটিত গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের প্রতি বিশ্ব বিবেকের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য পাচ শতাধিক মহিলা তাদের ছেলেমেয়ে ও শিশুসহ হাতে ‘নট এ পেনি নট এ গান, ইয়াহিয়া ভূট্টো-টিক্কা খান। ওয়ার্ল্ড পাওয়ার, এক্ট ফর হিউমানিটি, স্টপ জেনোসাইড, রিকগনাইজ বাংলাদেশ, লিবারেশন আর্মি উই আর উইথ ইউ, তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ, স্বাধীন বাংলা-স্বাধীন বাংলা জিন্দাবাদ-জিন্দাবাদ ইত্যাদি প্ল্যাকার্ড বহন করে টেমস নদীর উত্তর তীরবর্তী ভিক্টোরিয়া আমব্যাংকমেন্ট এলাকা হতে মিছিল করে ১০ ডাউনিং ষ্ট্রিটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিথের কাছে আবেদন পেশ করেন।
তারা অবিলম্বে বাংলা থেকে পশ্চিমা হানাদার বাহিনী অপসারণের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করেন। কমনওয়েলথভুক্ত বাংলাদেশের এই সংকটময় মূহূর্তে ব্রিটেনের অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করা উচিত বলেও দাবি জানান তারা। শোভাযাত্রাটি আমেরিকা, ভারত ও চীনসহ মোট দশটি দেশের দূতাবাসে স্মারকলিপি প্রদান শেষে হাইড পার্ক স্পিকার্স কর্ণারে গিয়ে শেষ হয়। জনমত পত্রিকার মতে, লন্ডন শহরে বাঙ্গালি নারীদের এতো বড় সমাবেশ আর কখনো দেখা যায়নি।
৩ এপ্রিলের সেই ঐতিহাসিক বিক্ষোভ সমাবেশের পর সমগ্র ব্রিটেনে সমিতির শাখা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরবর্তীকালে একে একে ব্রাডফোর্ড, প্রেস্টন, পোর্টসমাউথ, সাউদাম্পটন ও স্কটল্যান্ডে সমতির শাখা খোলা হয়। অতি অল্প দিনের মধ্যে সমিতির সদস্য সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫০ জনে। ৪ এপ্রিল বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের দাবিতে মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে জরুরি তারবার্তা পাঠানো হয়।
এছাড়াও উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে ছিলো :
*-৯ এপ্রিল থেকে প্রায় তিন সপ্তাহব্যাপী সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত পার্লামেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে নিজ এলাকার এমপিসহ বিভিন্ন এমপিদের সাথে আলাপ করে পাকিস্তানিদের বর্বরতার কাহিনী তুলে ধরে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের কাজ করেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যারা সে সময় লবিং করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন-মিসেস জেবুন্নেসা খায়ের, আনোয়ারা জাহান, সোফিয়া রহমান, বেগম কুলসুম উল্লাহ, বেলা ইসলাম, বদরুন্নেসা পাশা, মিসেস শরফুল ইসলাম খানসহ অনেকেই।
*-১৩ এপ্রিল, নয়টি সাহায্যকারী এইড কনসোর্টিয়াম সদস্যদের কাছে পাকিস্তানকে সাহায্য না করার দাবি জাননো হয়।
*-১৬ এপ্রিল বিশ্বের ৪৭টি দেশের রেডক্রিসেন্টের কাছে বাংলাদেশে সাহায্য পাঠানোর জন্য আবেদন জানানো হয়।
*-১৮ এপ্রিল পোপ জন পল ও আমেরিকার মিসেস নিক্সন, ব্রিটিশ প্রাধানমন্ত্রীর স্ত্রী সিসেস মেরি উইলসনসহ এমপিদের স্ত্রীদের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে সুপারিশের জন্য চিঠি প্রেরণ করা হয়।
*-২৭ এপ্রিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন সিয়াটো (SEATO) ও সেন্টো (CENTO) অধিবেশনের অতিথিরা আমন্ত্রিত হন। সেদিন সন্ধ্যা ৬টায় মহিলা সমিতির সদস্যরা ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের সামনে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। ‘পাকিস্তানকে সেন্টো থেকে বহিস্কার করো’ ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও’ ‘রক্ত যদি হয় স্বাধীনতার মূল্য তবে বাংলাদেশ অনেক রক্ত দিয়েছে’-এই জাতীয় নানা রকম শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড ছিল প্রত্যেকের হাতে হাতে।
*-১৪ মে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলীয় সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান কতৃক পাকিস্তান সম্পর্কে উত্থাপিত প্রস্তাবের উপর পূর্ণাঙ্গ আলোচনার তারিখ নির্ধারিত হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে মহিলা সমতির সদস্যরাও সেখানে যোগ দেন। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে বেষ্টনী করে প্রতিবাদ জানান হয়- যা তখনকার ব্রিটেনের সাধারণ মানুষকেও আকৃষ্ট করেছিল। সেদিন পার্লামেন্টের ১৬০ জন সদস্য প্রতিবাদকারীদের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যাক্ত করেছিলেন।
এর বাইরে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্যের জন্য অর্ধ শতাধিক স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে চিঠি পাঠায় তারা। প্যারিসে এইড পাকিস্তান কনসোর্টিয়াম-এর বৈঠক চলাকালে বিক্ষোভে যোগদানের জন্য রাজিয়া চৌধুরীকে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাস জুড়ে মহিলা সমতি তাদের সংগ্রাম চালিয়ে গেছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চিরায়িত বাঙালি রমণীর মতো ফিরে গেছেন ঘরকন্নায়। অনেকেই আবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়েছিলেন সে সময়। একমাত্র নোরা শরীফ রাজনীতির বাইরে থেকেও আমৃত্যু বাংলাদেশের সাথে জড়িয়ে ছিলেন।
-সুশান্ত দাস গুপ্ত’র ব্লগ থেকে।
বিবার্তা/এম হায়দার