নারীবাদীরা অভিযোগ করে থাকেন, সংস্কৃত ‘অঙ্গনা’ শব্দটিতে নারীর প্রতি সম্মানবোধ মোটেও ফুটে উঠেনি। বরং শব্দটির মাধ্যমে নারীর অঙ্গসৌষ্ঠবের আকর্ষকতাই মূর্ত হয়ে আছে।
অঙ্গ (দেহ) + ন (প্রশংসার্থে)= অঙ্গন। এখানে অঙ্গন মানে ‘যার প্রশস্ত অঙ্গ আছে’। কিন্তু স্ত্রীলিঙ্গে অঙ্গনা অর্থ অঙ্গসৌষ্ঠবসম্পন্ন নারী বা রমণী (কি রঙ্গে অঙ্গনা-বেশ ধরিলি, দুর্ম্মতি- মেঘনাদবধ কাব্য; নিশুম্ভমর্দ্দিনী অম্বে, মহাসমরপ্রমত্ত মাতঙ্গিনী, কম্পে রণাঙ্গন পদভারে একি! থরহর মহীসমুদ্র, পর্ব্বত ব্যোম, সুরনর শঙ্কাকুল কে এ অঙ্গনা- বাল্মিকীপ্রতিভা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; নাশ করে দুরদৃষ্ট, মুক্ত করি ভব কষ্ট, চন্দ্রের এই মনোভীষ্ট, ষোড়শী ভব অঙ্গনা-অপরূপা কে ললনা, হেরি রক্তাম্বুজাসনা- মহতাবচন্দ)।
বাংলা গানে রয়েছে: ‘এ কার অঙ্গনা, অঙ্গুদবরনা, চন্দ্রশেখরা ত্রিনয়না। রক্তবস্ত্র-পরিধানা, রক্তকমলাসনা, দ্বিভূজ-ধারণা বরাভয়-শোভনা। মধুপানযুক্ত, কালনৃত্যাসক্ত, হেরি ফুর বক্র, অনঙ্গ-অরি-অঙ্গনা, অদ্যাকালী কৃপালেশে, বিনাশি চন্দ্র কলুষে, মুক্ত করো মায়াপাশে, দিয়ো না যাতনা।’
অন্যদিকে বাংলায় ‘অদল’ শব্দটি সংস্কৃত থেকে যেমন এসেছে, তেমনি আরবি থেকেও এসেছে। সংস্কৃত অ + দল= অদল মানে দলহীন, পাপড়িশূন্য। আবার আরবি ‘উদুল’ থেকে আসা বাংলা অদল মানে পরিবর্তন (পূর্বাপর তার একই রকম থেকে যেতো তার মতিগতিতে যদি কোন অদল না হোত- ওবায়েদুল হক)।
তবে বাংলায় সাধারণত ‘অদলবদল’ শব্দটি বেশি ব্যবহৃত হয় (মন্ত্রিপরিষদ অদলবদল করেও সরকার দ্রব্যমূল্য কমাতে পারেনি)।
বাংলায় হাইব্রিড বা শঙ্কর শব্দের উদাহরণ হচ্ছে এই ‘অদলবদল’ শব্দটি। আরবি বদল্ থেকে বাংলায় ‘বদল’ শব্দটি এসেছে। তবে অর্থে পার্থক্য আসেনি। বদল মানে বিনিময়, পরিবর্তন। আরবি বদল্ শব্দের অনুকরণে বাংলা ‘অদল’ শব্দটি বদল শব্দের আগে যুক্ত হয়েছে। অদলবদল মানে বিনিময়, পরিবর্তন, পাল্টাপাল্টি। হিন্দিতেও একই অর্থে শব্দটি প্রচলিত। বাংলা অদল-বদল এর সমতুল শব্দ হিন্দিতে উথল-পুথল।
বিশেষণে অজ মানে খাঁটি (চেয়ে চেয়ে দেখি অজপাড়াগাঁর চেহারা- মনোজ বসু), নিরেট (তার মত অজমূর্খ খুব একটা চোখে পড়ে না)। এই অজ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘আদ্য’ থেকে। শব্দটির বিবর্তন হচ্ছে: আদ্য > অজ্জ > অজ। বিশেষণ হিসেবে অজ শব্দ দিয়ে জন্মহীন বা চিরবর্তমানও বোঝায়।
এক্ষেত্রে শব্দটির গঠন হচ্ছে সংস্কৃত অ (নঞ) + জন (উৎপন্ন হওয়া) + অ (ড)। আবার বিশেষ্য হিসেবে অজ শব্দের গঠন হচ্ছে সংস্কৃত অজ (গমন) + অচ্। এই অজ অর্থ ছাগল, মেষ (পুত্র হৈলে দুই অজা সুতা হৈলে এক- আলাওল)।
রামের ‘পিতামহ’ এবং ‘ছাগ’ এই দ্ব্যর্থবাচক ‘অজ’ শব্দ ব্যঙ্গস্তুতি অলঙ্কারে স্তুতিচ্ছলে নিন্দাও প্রকাশ করে। যেমন ‘বিবাহ করিয়া সীতারে লয়ে, আসিছেন রাম নিজ আলয়ে, শুনিয়া যতেক বালক সবে, আসিয়া হাসিয়া কহে রাঘবে, শুন হে কুমার; তোমারি আজ, কুলের উচিত হইল কাজ, তবে হে জনম অতি বিপুলে, ভুবন-বিদিত অজের কুলে; জনকদুহিতা বিবাহ করি তাহাতে ভাসালে যশের তরি- কাব্যনির্ণয়)। এখানে স্তুতি হিসেবে অজ= অজরাজ, জনকদুহিতা= সীতা। অন্যদিকে নিন্দা হিসেবে অজ= ছাগল, জনক-দুহিতা= ভগিনী বা বোন।
অজ মানে ‘যে জন্মে না’। সোজা কথায় ঈশ্বর। তবে শব্দটির অনেক অর্থ রয়েছে। ‘অজ’ অর্থে ছাগলও হয়। কারণ ‘অজ’ শব্দের আরেকটি ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘যে তৃণের খোঁজে অন্যত্র গমন করে’ (পুষ্ট অজা আনিয়া সকলে দিল বলি- সৈয়দ সুলতান)।
অজ বা অজা থেকে অজামুখ শব্দটিও এসেছে। এটার অর্থ ছাগলের ন্যায় মুখ (ভুঞ্জিবা এহার ফল হৈবা অজামুখ- গৌরীমঙ্গল, কবিচন্দ্র মিশ্র)।
অজ মানে অনাদিকাল থেকে বর্তমান। কিন্তু বাংলায় শব্দটির অর্থাবনতি ঘটেছে। নিতান্ত মন্দ অর্থে বাংলায় অজ শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। যেমন অজপাড়াগাঁ, অজমূর্খ। আবার অজাগলস্তন মানে ছাগীর গলদেশে স্তনবৎ দৃষ্ট মাংসপিণ্ডের ন্যায় অপ্রয়োজনীয় অংশ।
অজ শব্দের প্রাচীন অর্থ ছিল মেষ। কালের বিবর্তনে এটি ছাগলের প্রতিশব্দ হয়ে গেছে। আদি, খাঁটি, ঠিক অর্থে যে অজ (অজ পাড়াগাঁ) শব্দটি বাংলায় চালু রয়েছে, তা বাংলা বিশেষণ, এমনটাই লিখেছেন হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষে। তিনি ধারণা করেছেন, বাংলা বিশেষণ অজ শব্দের মূল সংস্কৃত ‘আদ্য’, যা প্রাকৃতে ‘অজ্জ’ হয়ে বাংলায় অজ হয়েছে। তিনি একাধিক উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন অজ কোণ- ঠিক কোণ, অজ গোড়া- আদৎ গোড়া, অজ চাষা- আদৎ চাষা, অজ বঞ্জর- আদৎ অনুর্বর পতিত জমি।
জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া