এক সময় ‘পশ্চাৎ কথন’ অর্থে অনুবাদ শব্দটির প্রয়োগ ছিল (মধ্যলীলার ক্রম এবে করি অনুবাদ- চৈতন্যচরিতামৃত)। বর্তমানে শব্দটি ভাষান্তর অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রতিকূলতা বা শত্রুতা অর্থেও অনুবাদ শব্দটি প্রচলিত ছিল (বিধি করে অনুবাদ)।
তরজমা বা ভাষান্তরকরণ অর্থেও সংস্কৃতে অনুবাদ শব্দটি চালু রয়েছে। আবার গালি, অপবাদ অর্থেও সংস্কৃতে অনুবাদ শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায় (কবহু মাধব সেই মানিনী প্রসাদে। আসিব যায়ব তুয়া দূত অনুবাদে- শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল)। কিংবদন্তী, জনশ্রুতি ও প্রথমে কথিত, জ্ঞাত বস্তু অর্থেও সংস্কৃতে অনুবাদ শব্দটি প্রচলিত। কিন্তু বাংলায় অনুবাদ মানে প্রতিকূলতা, শত্রুতা (মনে ছিল অনুবাদ, অকলঙ্ক কুলে কালি দিল- জ্ঞানদাস)।
মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রশংসা, স্তুতিবাদ অর্থেও বাংলায় অনুবাদ শব্দের প্রয়োগ রয়েছে (ধন্য ধন্য করিয়া করিল অনুবাদ- গঙ্গামঙ্গল)। অন্যদিকে সংস্কৃতে অনুবাদক অর্থ অর্থব্যঞ্জক, অর্থ প্রকাশক, অনুগুণ, সদৃশ, অনুরূপ। কিন্তু বাংলায় ‘যে অনুবাদ করে’ সে ভাষান্তরকারক (হাইনের কবিতা বাঙলায় অনুবাদ করেছেন প্রধানত সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত- কই সে, সৈয়দ মুজতবা আলী)।
ভাষান্তরিত অর্থে বাংলায় ‘অনুবাদিত’ শব্দটিকে ভুল বলার সুযোগ নেই (ইংরেজিতে অনুবাদিত হইয়া ইংলণ্ডে যায়- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)। কিন্তু সংস্কৃতে বাংলা অনুবাদিত শব্দের সমতুল হচ্ছে ‘অনূদিত’। মনিয়ের উইলিয়ামসে ‘অনুবাদিত’-কে অসাধু বলা হয়েছে। সংস্কৃতে অনূদিত অর্থে ‘পশ্চাৎ কথিত’ চালু রয়েছে।
‘চৈতন্যচরিতামৃতে’ এখন থেকে ৪০০ বছরেরও আগে ‘অনুবাদ’ বলতে বোঝানো হয়েছে ‘কোনো গ্রন্থ থেকে আবৃত্তি করা’। ‘রাগ’ বললে এখন আর ‘অনুরাগ’ বোঝায় না, যা বোঝায় তা অনুরাগ বৃদ্ধি করে না, বরং রাগের মাথায় আমরা অনুরাগকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে থাকি।
১৫ শ’ শতকের কবি বিজয়গুপ্তের পদ্মপুরাণে (মনসামঙ্গল) অনুবাদ মানে অপরাধ (নাহি দোষ অনুবাদ খেমা কর আমা)। আবার কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর চৈতন্যচরিতামৃতে অনুকীর্তন অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেছেন (লিখিত গ্রন্থের যদি করি অনুবাদ, তবে সে গ্রন্থের পাইয়ে আস্বাদ)।
ভাষান্তরকরণ অর্থে অনুবাদ শব্দের সমতুল শব্দ আরবিতে তরজুমাহ। তরজুমাহ লখফী হচ্ছে আক্ষরিক অনুবাদ আর তরজুমাহ মহাবিরাহ হচ্ছে ভাবানুবাদ। আরবিতে অনূদিত শব্দের সমতুল শব্দ মুতরযম।
জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া