বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত ‘অকাট্য’ শব্দটি নিয়ে একাধিক ব্যাকরণবিদের আপত্তি আছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে ‘যা কাটা যায় না বা খণ্ড করা যায় না’- এই অর্থে প্রচলিত ‘অকাট্য’ শব্দটি নকল সংস্কৃত বা লৌকিক সংস্কৃত। তবে বাংলা ‘কাট্’ ধাতুতে কৃৎ প্রত্যয় হয়েছে ধরে নিলে বিরোধ কমতে পারে। তারপরও শব্দটি সমানে চলছেই (তাহার অকাট্য অপরিবর্তনীয় লৌহের ন্যায় কঠিন নিয়মশৃঙ্খলে কয়জনে মমতা দেখিতে পায়?- অব্যক্ত, জগদীশচন্দ্র বসু)।
এ ধরনের আরেকটি শব্দ হচ্ছে ‘কহতব্য’। অকাট্য শব্দের সমার্থক শব্দ হচ্ছে অকর্তিত, অকাট, অখণ্ডনীয়, অখণ্ডিত, অখণ্ড্য, অচ্ছেদিতব্য, অচ্ছিন্ন, অচ্ছেদিত, অচ্ছেদ্য, অচ্ছেদ্যনীয়, অবিভক্ত, অবিভাজ্য, অভেদী, অভেদ্য।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘অকারী’ শব্দটির উদ্ভাবক। অকারী মানে ‘যে কাজ করে না, জড়, নিষ্ক্রিয়’। তিনি অকারী শব্দের বিপরীত হিসেবে ‘সকারী’ শব্দটিরও উদ্ভাবক। তিনি তার ‘রাশিয়ার চিঠি’ নামের ভ্রমণকাহিনীতে লিখেছেন ‘সে ম্যুজিয়ম আমাদের শান্তিনিকেতনের লাইব্রেরির মতো অকারী (passive) নয়, সকারী (active)।’
আর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘উটপাখী’ কবিতায় অকারী শব্দটি ব্যবহার করেছেন (ভূমিতে ছড়ালে অকারী পালকগুলি, শ্রমণশোভন বীজন বানাব তাতে, উধাও তারার উড্ডীন পদধূলি পুঙ্খে পুঙ্খে খুঁজব না অমরাতে)।
সংস্কৃতে অকাল মানে ‘স্মৃতিশাস্ত্রের অশুভ কাল’। আর হিন্দিতে ‘অকাল’ দুর্ভিক্ষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। আবার সংস্কৃত ‘অ’ প্রত্যয় বাংলায় ‘আ’ হয়ে অকাল আকাল হয়েছে। বাংলায় আকাল মানে দুঃসময়, দুর্ভিক্ষ ও অভাব। হিন্দিতেও ‘অকাল’ শব্দটি একই তাৎপর্য বহন করে।
অকাল শব্দের মূলানুগ অর্থ ‘অনুপযুক্ত বা অপ্রত্যাশিত কাল’। ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র মতে অপ্রশস্ত কাল। কিন্তু সংস্কৃত এ শব্দটির বাংলা অর্থ ‘দুর্ভিক্ষ’। অথচ সংস্কৃতে অকাল দিয়ে দুর্ভিক্ষ বোঝায় না (সূর্যের কুয়াশা এখনো কাটেনি, ঘোচেনি অকাল দুর্ভাবনা, মুহূর্তের সোনা এখনো সভয়ে ক্ষয় হয়- সুকান্ত ভট্টাচার্য)। অবশ্য হিন্দিতে দুর্ভিক্ষের সমতুল শব্দ ‘পানকাল’।
মধ্যযুগের বাংলায় অকালের সমতুল শব্দ ছিল ‘অদিন’ (অদিনেতে পালিমু তোমারে- ভবানীদাসের মীনচেতন, ১৫ শ’ শতক)।
‘অসময়ে’ অর্থেও বাংলায় অকাল শব্দটি চালু রয়েছে (দুয়ারে পা বাড়াতেই চোখে পড়ল মেঝের ’পরে এলিয়ে পড়া ওর অকাল ঘুমের রূপখানি- অকাল ঘুম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
অন্যদিকে অকুমারী বলতে সাধারণ অর্থে ‘কুমারী নয়’ বোঝায়। তবে শব্দটি দিয়ে ‘প্রকৃষ্ট কুমারী’ও বোঝায়। এই শব্দের আরও প্রয়োগ রয়েছে। চর্যাপদ ও মধ্যযুগীয় কিছু রচনায় ‘অ’ এর ভিন্ন রূপ লক্ষ্যণীয়। মধ্যযুগের বাংলায় ‘অ’ পূর্ণতা অর্থে ব্যবহৃত হত। যেমন: অকুমারী= পূর্ণ কুমারী (অকুমারী কালে জন্ম হইল নন্দনে- কাশীরামের মহাভারত; অকুমারী নারী সব মাগিব শৃঙ্গার- ভবানীদাসের ময়নামতীর গান; অকুমারীর স্তন যেন ক্ষীরের নাই গন্ধ- বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল; কি করিতে পারি আমি নারী অকুমারী- কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ)।
তবে কালের প্রবাহমাত্রায় ‘অ’ শব্দের শুরুতে বসে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে থাকে। বর্তমানে চলিত ভাষায় ‘অ’ উপসর্গ শব্দের শুরুতে বসে বিরোধ, অপ্রশস্ততা, অল্পতা, অভাব, অন্যতা এবং সাদৃশ্য অর্থ প্রকাশ করে থাকে।
আবার যথার্থ বা নিতান্ত কুমারী অর্থে মধ্যযুগের বাংলায় অকুমারী শব্দের ব্যবহার ছিল (অকুমারী আছ তুমি প্রথম যৌবনে- ধর্মমঙ্গল, ঘনরাম চক্রবর্তী; পরমা সুন্দরী কন্যা অকুমারী বেশ, চণ্ডীর প্রহারে তার তনু হইল শেষ- মনসামঙ্গল, বিজয় গুপ্ত)। সৈয়দ আলাওলের সিকান্দারনামায় বার বছরের কম বয়স্ক নারী অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে (পরম সুন্দরী যত অকুমারী বালা)।
আবার মধ্যযুগের বাংলায় অকুমারী বা অবিবাহিত অর্থে ‘অবিবাহ’ শব্দটিও চালু ছিল (অবিবাহ এত বড় তোমার ভগিণী- ঘনরামের ধর্মমঙ্গল)। একই অর্থে প্রচলিত ছিল ‘অবিবাই’ ও ‘অবিবাহি’ শব্দ দুটোও (আমি কন্যা অবিবাই মা বাপের ঘরে- সৈয়দ হামজার মধুমালতী; অবিবাহি গর্ভবতী আপদের চিন- কেতকাদাসের ধর্মমঙ্গল)। কেতকাদাস একই গ্রন্থে ‘অবিভাই’ শব্দটিও রেখেছেন (এত বড় যোগ্য কন্যা কনে অবিভাই)। আবার শেষ চান্দের হরগৌরীসম্বাদে একই অর্থে ‘অবিয়ান্তা’ শব্দটির প্রয়োগ রয়েছে (অবিয়ান্তা তুই বালি লুরারে বরিতে চাইলি)।
জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া