‘অন্তর’ বেদে ব্যবহৃত শব্দ। সংস্কৃতে এটার রয়েছে নানা অর্থ। মধ্যবর্তী (তুলনীয় আবেস্তায় anantara, লাতিনে inter, গথিকে anthar, ইংরেজিতে interior), আত্মীয়, স্বীয়, অন্য, সদৃশ্য, ব্যবধায়ক, অন্তকরণ, পরমাত্মা ইত্যাদি। কিন্তু বাংলায় অন্তর মানে বাহির (ধেকা মারি করিব তোরে পুরির অন্তর- মীনচেতন)।
বাংলায় ক্রিয়া-বিশেষণ হিসেবেও অন্তর শব্দের প্রয়োগ রয়েছে। হরিচরণ বন্ধ্যোপাধ্যায় মতে, এ অন্তরের মূল সংস্কৃত ‘অনন্তর’। আর বাংলা ক্রিয়া-বিশেষণ অন্তর মানে পরে (দশ দিন অন্তর রাজার দশা করিল গোচর- গোপীচন্দ্র)। আর অন্তরে মানে পরে (ইহার অন্তরে তবে শুন সর্বজনে- কাশীদাসী মহাভারত)। এই পরে বা অন্তে ভাবধারায় বাংলায় বিবাহঅন্তরে, মাসান্তরে, পঞ্চাদিনান্তরে, সন্ধ্যাধূপ-অন্তরে শব্দের প্রয়োগ রয়েছে (দেখুন, হরিচরণের বঙ্গীয় শব্দকোষ)।
বিশেষ্য হিসেবে অন্তর মানে মন (অন্তরমম বিকশিত কর অন্তরতর হে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; প্রতারণাহীনা তবু সমূহ সুন্দর, শীর্ণকায়া স্রোতস্বিনী শোধিত অন্তর- মুহাম্মদ নুরুল হুদা; আমার প্রাচীন দেশের পরিপক্ক শিশাকে আমার চিরতরুণ অন্তরে ধারণ করব- অন্নদাশঙ্কর রায়; রাত্রির ফুলের মত, হেমন্তের হৃদয়ের মত অন্তর ঘুমায়ে গেছে, ঘুমায়েছে মৃত্যুর মতন- জীবনানন্দ দাশ), ভেতর (তিনি এখন ঘরের অন্তরে; তারপরে সত্য দেখা দেয় ভূষণবিহীন রূপে, আলো করি অন্তর বাহির- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), পার্থক্য (বড় সাহেবের সাথে মেজ সাহেবের মতান্তর চলছে), তফাত (কিঞ্চিৎ অন্তরে কিঙ্করকে দেখিতে পাইয়া- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; এয়ার হোস্টেজ দুই ঘণ্টা অন্তর খাওয়াচ্ছেন- মুহাম্মদ আবদুল হাই), অবসান (শিশুতা অন্তরে হৈল যৌবন বিস্তার- ভবানন্দ), আত্মীয় (অন্তরতম হে সুন্দর)। অন্যদিকে বিশেষণে অন্তর মানে ভিন্ন, অন্য (অবশেষে সে দেশান্তরে গেল)।
আবার ইংরেজি international শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে আন্তর্জাতিক। এ পারিভাষিক শব্দটির বঙ্গানুবাদ নিয়ে মতবিরোধ থাকলেও ‘আন্তর্জাতিক’ শব্দটি আজ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তবে কাজী নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক শব্দের পরিবর্তে ‘অন্তর-ন্যাশনাল’ লিখেছেন (এই অন্তর-ন্যাশনাল সংহতি রে)।
তাঁর ‘অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত’ এর শেষ প্যারা হচ্ছে:
‘নব ভিত্তি ’পরে নব নবীন জগৎ হবে উত্থিত রে! শোন্ অত্যাচারী! শোন্রে সঞ্চয়ী! ছিনু সর্বহারা, হব’ সর্বজয়ী।। ওরে সর্বশেষের এই সংগ্রাম-মাঝ, নিজ নিজ অধিকার জুড়ে দাঁড়া সবে আজ! এই ‘অন্তর-ন্যাশনাল-সংহতি’ রে হবে নিখিল-মানব-জাতি সমুদ্ধত।’
নজরুলের বহুল প্রচারিত কবিতা সংকলনগ্রন্থ ‘সঞ্চিতা’য় পুরো গানটি ‘অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত’ (আসলে ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল সং’) রূপে মুদ্রিত আছে। এটি তাঁর ‘ফণিমনসা’ (১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় নজরুলের কমিউনিস্ট বন্ধু মুজফফর আহমদ সম্পাদিত ‘গণবাণী’ পত্রিকায়। নজরুল গবেষক ড. অরুণকুমার বসু বলেন ‘১৩৩৪ বঙ্গাব্দের নববর্ষ দিবসে ‘রক্তপতাকার গান’, ‘অন্তর ন্যাশনাল সঙ্গীত’ ও ‘জাগর তূর্য’ এই তিনটি বিপ্লবের গান নজরুল আমাদের উপহার দিয়েছিলেন।’
ইংরেজি ইন্টারন্যাশনাল শব্দের বাংলা প্রতিবর্ণায়ন ‘অন্তর-ন্যাশনাল’ শব্দটিতে অতলান্তিক শব্দের প্রভাব থাকতে পারে। কারণ এক সময় ইংরেজি আটলান্টিক থেকে আসা ‘অতলান্তিক’ শব্দটিকে সংস্কৃত হিসেবে দেখানোর বাতিক ছিল। আরবিতে আন্তর্জাতিক এর সমতুল শব্দ আলামিয়্যাহ।
জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া