বাংলায় ঢোকার পর অধিকাংশ সংস্কৃত শব্দ তার আসল চরিত্র বা অর্থ থেকে দূরে সরে যায়। অদ্ভুত শব্দটিও তার ব্যতিক্রম নয়। সংস্কৃতে অদ্ভুত মানে বিস্ময়কর। কিন্তু বাংলায় শব্দটির অর্থ উদ্ভট বা সৃষ্টিছাড়া। অবশ্য বিস্ময়কর অর্থেও শব্দটির ব্যবহার বাংলায় বিরল নয়।
সংস্কৃতে অদ্ভুত শব্দটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয় না। সংস্কৃতে অদ্ভুত মানে বিস্ময়কর, আশ্চর্য (অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ- জীবনানন্দ দাশ; সুবর্ণ গড়ের জত কাঙ্গুরা অদ্ভুত- সৈয়দ আলাওল; হঠাৎ কেমন অদ্ভুত শব্দ শুনে ওরা সচকিত হয়ে উঠে, মহাপতঙ্গ- আবু ইসহাক)। অর্থাৎ বাংলায় সংস্কৃত অদ্ভুত শব্দের সংস্কৃত অর্থগুলিও চালু রয়েছে।
অবশ্য কিম্ভূতে ভূত থাকলেও অদ্ভুতে ‘ভূত’ নেই। কারণ শব্দটির ব্যুৎপত্তি হচ্ছে অৎ+(ভূ+উত)। শেষের এই ‘উত’ প্রত্যয়ের কারণে দীর্ঘ উকারান্ত ভূ হয়ে গেছে ভুত। শব্দটি স্বরাগমে অদ্ভুত অদভুত বা অদভূত হয়ে যেতে পারে।
মধ্যযুগের বাংলায় তাই অদভুত ও অদভূত বানান দেখা যায় (অদভুত লাগে তোর সুনিআঁ বচন- বড়ু চণ্ডীদাস)। আর প্রাচীন বাংলায় বর্তমানের ‘অদ্ভুত’ শব্দের সমতুল শব্দ ছিল অদভুঅ, অদভুআ। চর্যাগীতিকায় রয়েছে ‘উইও গঅণ মাঝে অদভুআ, পেখরে ভুষুকু সহজ সরূআ, অদভুঅ মোহ রে’।
প্রাচীন বাংলায় অদভুত শব্দটিও প্রচলিত ছিল (হেন অদভুত কথঅ শুন ল বড়ায়ি; অদভুত লাগে তোর সুনিআ বচন- বড়– চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)। স্ত্রীলিঙ্গে ‘অদভুতা’ শব্দটিরও ব্যবহার তখন ছিল (অতি বুদ্ধিমন্ত কন্যা রূপে অদভুতা- সৈয়দ সুলতান)। প্রাকৃতে বাংলা অদ্ভুত শব্দের সমতুল হচ্ছে অদঅভুঅ, অদভুয়া। এক প্রকার কাব্যরসের নামও অদ্ভুত। আবার নাট্য শাস্ত্রে উপাঙ্গভিনয় ভঙ্গীই অদ্ভুত।
অন্যদিকে বাংলায় নিম্নস্থান অর্থেও অধর শব্দের প্রয়োগ আছে (প্রাণের আহূতি জ্বালি হৃদয়ের অধরে উত্তরে- অমিয় চক্রবর্তী; যেন অতৃপ্ত আবেগে আমার পাণ্ডুর অধরের শেষ রক্তবিন্দু শুষে নিতে লাগল- শব্নম্, সৈয়দ মুজতবা আলী)। কিন্তু অমরকোষের টীকাকার মহেশ্বর লিখেছেন, ‘যারা বলেন অধর শব্দে নিম্ন ওষ্ঠকে বোঝায়, তাদের কথা যুক্তিসঙ্গত নয়’।
প্রবাল ও বিল্ব বা পাকা তেলাকুচা ফলের সাথে অধরের তুলনা এসেছে বারবার (অধর বিল্বর খাইতে মধুর চঞ্চল খঞ্জন আঁখি- ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর)। তুলনা এসেছে অমৃতের সঙ্গেও (অধর-অমৃত আশে ভুলিনা অমৃত দেব-দৈত্য, নাগদল নম্রশিরঃ লাজে হেরি পৃষ্ঠদেশে বেণী- মাইকেল মধুসূদন দত্ত)। অধরপল্লব মানে কচি পাতার মতো নরম ঠোঁট। আর অধরপান বা অধর সুধাপান মানে চুম্বন। অধরোষ্ঠ অর্থ নিচের ও উপরের ঠোঁট।
শাস্ত্রীয় নৃত্য ও নাট্যশাস্ত্রে অধরের বিশেষ ব্যবহার রয়েছে। অধর বা ঠোঁটের অভিব্যক্তিময় আন্দোলন বা অবস্থাকে বলা হয় অধরকর্ম। নাট্যশাস্ত্রে অধরকর্ম ছয় প্রকার: বিকর্তন, কম্পন, বিসর্গ, বিনিগুহণ, সংদৃষ্ট ও সমুদ্ধক। সংকুচিত অধরদ্বয় বিকর্তন (দুঃখ, যন্ত্রণা, অবজ্ঞা বোঝাতে), কম্পিত হলে কম্পন (ক্রোধ, ভয়, দুর্বলতা, বিজয় বোঝাতে) সংবদ্ধ অবস্থায় রমণীয় ভাব প্রকাশ করলে বিসর্গ (বিলাস, চুম্বন বোঝাতে), ঠোঁট দুটি দৃষ্ট হলে সংদৃষ্ট (শোধ, প্রতিশোধ বোঝাতে) এবং ঠোঁট দুটি গোলাকার থাকলে সমুদ্ধক বোঝায়। সমুদ্ধকের মাধ্যমে অভিনন্দন, চঞ্চলতা ভাব ফুটিয়ে তোলা হয়।
বাংলা ভাষায় কবি-সাহিত্যিকরা বেশ সাবলীল ভাবেই অধর শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন (গগনেতে শশধর নীচে কামিনী অধর, অমিয় বরিষে তার মধুর বচন- কাশীপ্রসাদ ঘোষ; যে নারী ফেরালো মুখ, যে অধরে গোলাপ কেঁপেছে, দুজনারি কাছে ঋণী, আরো ঋণ করে যেতে চাই- আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ; অরণ্যের বিষণ্নতার ভেতর হঠাৎ বিচ্ছুরিত বসন্তের মঞ্জুরিত রাজফুলের মত তোমার রক্তিম অধর- বেলাল চৌধুরী; অধরোষ্ঠ পাশে রহস্য কৌতুকে মেশা হাসির আবীর সুদূর করেছে তারে করেছে নিবিড়- মনীশ ঘটক)।
জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া