যে মানুষেরা হাজারো কষ্টের ভিড়ে ভেজালমুক্ত কিছু ভালোবাসাকে আঁকড়ে ধরে এক চিলতি সুখ খুঁজে নিয়ে হাসিমুখে অনায়াসে বলতে পারে, "আমি ভালো আছি।", সেইসব মানুষদের মধ্যবিত্ত বলে। মধ্যবিত্তদের প্রধান সম্পদ হচ্ছে তাদের সম্মান। তাদের আত্মসম্মানটা খুব সেনসিটিভ। মধ্যবিত্ত মানুষদের গরীব হয়েও প্রতিনিয়ত ধনী থাকার অভিনয় করতে হয়। কারণ তারা তাদের দূর্বলতা কাউকে বুঝাতে চায় না। তারা চায় না কেউ তাদের সম্মানে আঘাত করুক। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মানুষগুলা খুব শক্ত হয়। কারণ তাদের একের পর এক বাঁধা পেরিয়ে বড় হতে হয়েছে। একের পর এক স্বপ্নকে অদূরেই জ্যান্ত কবর দিতে হয়েছে অভাবের সমাধিতে। তাদের চাওয়াটা সবসময় পাওয়া হয়ে উঠে না। তাই বলে তারা থেমে থাকে না। স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে না। এই স্বপ্নগুলোই তাদের বাঁচিয়ে রাখে। তাদের বেঁচে থাকার শক্তি জোগায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষরাই সব থেকে বেশে স্বপ্ন দেখে। কষ্টকর হলেও সত্য এটাই যে বেশিরভাগ স্বপ্নই অপূরণীয় থেকে যায়।
আমার জীবনের একটা ঘটনাই বলি। একবার আমি বাবার কাছে একটা দামী জিনিসের জন্য বায়না করলাম। মধ্যবিত্তদের জন্য এটা সত্যিই অনেক দামী। আমার বাবার প্রায় এক মাসের বেতনের সমান। কিন্তু তাও তিনি আমাকে না করেন নি। এক মিনিট স্তব্ধতার পরে হাসিমুখে বলেছিলেন, "আচ্ছা বাবা। পরের মাসে শিওর কিনে দিবো।" স্কুলে যাদের সাথে পড়তাম তাদের অধিকাংশারই ছিলো অনেক ধনী ফ্যামেলির। তাদের বাবার তুলনায় আমার বাবা ছিলেন অনেক গরীভ। তাদের হাতে যখনই নতুন কিছু দেখতাম তখনই আমি বাবার কাছে সে জিনিসটার জন্য বলতাম। আমার বাবা আমার আবদার রাখতেন। কখনো আমায় না করেন নি। কিন্তু এবারের চাওয়াটা একটু বেশীই ছিলো। তাও আমার বাবার রাজি হওয়া দেখে আমি প্রায় অবাক হই।
এরমধ্যে হঠাৎ একদিন আমার দাদি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার দেখানোর পর বলা হয় অপারেশন করতে হবে। আমার বাবা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। আমি তখনও বাবার চিন্তিত মুখের মানেটা বুঝিনি। রাতে খাবার পর বাবার ঘরে উঁকি দেই। বাবা খেতে আসেননি। তিনি আমায় দেখে তার ঘরে ডাকলেন। এই প্রথমবার আমি তার চোখে জল দেখলাম। আমি আমার বাবাকে কোনোদিন কাঁদতে দেখিনি। অনেক শক্ত উনি। তবে আজ কি হল? আমায় জড়িয়ে ধরলেন। আমি কিছুই বুঝতে না পেরে অবুঝ দৃষ্টিতে তার দিকে ছেয়েছিলাম।
তিনি বললেন," বাবা, তোমার দাদি অসুস্থ। অপারেশন করতে অনেক টাকা লাগবে। আমার কাছে এতো টাকা নেই। তুমি জানোই তো বাবা। তোমার ওই জিনিসটা কিনে দেওয়ার জন্য আমি টাকা তুলে রেখেছিলাম। তোমার দাদির এই অবস্থা তুমিই বল কি করবো? আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু আমারতো কিছু করার নেই। তুমি অনেক বড় হয়েছো। তুমি তো বুঝো। তাই না? প্লিজ আমাকে মাফ করে দিও। পরের বার সত্যি কিনে দিবো। মন খারাপ করো না বাবা। " এক মুহূর্তের জন্য আমার মাথা ঘুরছিলো। আমার চোখ ঝাপ্সা হয়ে উঠে। আমি দৌড়ে আমার রূমে চলে যাই। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়েছিলো তখন। খুব কান্না পাচ্ছিলো। আমি বাবার কাছে সেদিন ক্ষমা চেয়ে বলেছিলাম আমার কিচ্ছু লাগবে না।
ছোটকাল থেকে দেখে আসছি আমার মা অনেক দামী শাড়ি কিনেন। উনার শাড়ির খুব শখ। প্রতি ঈদে দুই-তিনটা দামী শাড়ি কিনতেন। যখন আমি একটু বড় হলাম। দেখলাম মায়ের শাড়ির বাজেটটা কমে গেলো। হাসিমুখেই তিনি আমাদের দিকে ছেয়ে তার শখটাকে ভুলে গেলেন। এখন মা খুব সস্তা শাড়ি কিনেন। তাও ঈদে বেশি হলে একটা। কোনো ঈদে কিনেনও না। বলেন ইচ্ছা নাই। শুধু আমাদের জন্য। কিন্তু কখনো আমাদের কিছু কিনে দেয়ার সময় কোনো কথা বলেন না। আমাদের ইচ্ছানুযায়ী কাপড় কিনে দেন, হোক সেটা আকাশচুম্বী দামের। শুধু আমাদের মুখে এক চিলতি হাসি দেখার জন্য। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না আমার ৮ বছর বয়স থেকে আমার বাবা নিজের জন্য নিজের টাকায় এক টুকরো কাপড় কিনেন নি। কেউ গিফট দিলে আর না হয় আম্মু কিনে দেন। আমি অবাক হই কীভাবে মানুষ এতোটা অদ্ভুত হয়। কোনো শখ নেই, নেই কোনো ইচ্ছা।
মধ্যবিত্ত ফ্যামেলির মায়েরা ম্যাজিক জানেন। সত্যিই ভেবে দেখুন। মাসের ১০ দিনের মাথায় যখন সংসার খরচের টাকা অর্ধেক হয়ে যায়, তখন বাকি অর্ধেক টাকা দিয়ে ২০ দিন কীভাবে চালান?? এই কাজটা শুধু একজন মধ্যবিত্ত ফ্যামেলির মায়েদের ক্ষেত্রেই সম্ভব। ঘরে মানুষ চারজন। মাছ রান্না হবে চারটা। হঠাৎ ছেলে বলে উঠলো," মা, মাছটা খুব মজা হয়েছে। আরেক পিস হবে?" মা এক মিনিটও দেরি না করে ছেলের প্লেটে মাছ তুলে দিবেন হাসিমুখে। যখন জিজ্ঞেস করা হবে, " তোমার পিসটা কই?" তখন বলবেন," আছে তো। আমার জন্য রেখে এসেছি। " আর না হয়," এই মাছ আমি খাই না। আমার ভালো লাগে না।" অনেক সময় এই প্রশ্নগুলো এড়াতে সবার শেষে শূন্য প্লেটে ভাতের সাথে মরিচ আর লবণ মিশিয়ে খেয়ে নেন।
কই? তাদের তো কোন প্রতিবাদ থাকে না? কোনো অতৃপ্তি থাকে না? কারণ তারা সুখ খুঁজতে শিখে নিয়েছেন। একজনের হাসি থেকে কীভাবে সুখ খুঁজে নিতে হয় তারা জেনে গেছেন। এই মায়েরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অর্ধাঙ্গিনী। এই মায়েদের জন্যই হয়তো কবি লিখেছিলেন," প্রত্যেক পুরুষের সফলতার পেছনে একজন নারী রয়েছেন" মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা মাঝে মাঝে বুঝতে পারেন না তারা আসলে কি? ধনী না গরীব? কারণ, ধনীদের মতো তাদের ঘরেও একটা টিভি থাকে, কিন্তু ১৪ ইঞ্চির।তাদের ঘরেও ফ্রিজ থাকে, কিন্তু ছোট সাইজের। তারাও অনেক বড় বড় বাসায় থাকেন, শুধু এক বাথরুম আর বারান্দাবিহীন। তিনবেলা তাদের মুখেও ভাত জুটে, কিন্তু মাংস না। তারাও প্রতি ঈদে কাপড় কিনেন, শুধু বাজেটটাই কম। তাদেরও সবার হাতে মোবাইল থাকে, কিন্তু কমদামী। দূরে কোথাও তারাও বাসে যায়, কিন্তু লোকাল। ছুটিতে তারাও বেড়াতে যায়, কিন্তু সিংগাপুর, ব্যাংককে নয়।
মধ্যবিত্ত ফ্যামেলির মানুষেরা সত্যিই অদ্ভুত। তারা ৫ তারা হোটেলেও খেতে পারে, আবার রাস্তার মোড়ের টঙ দোকানে বসে চাও খেতে পারে। তারা যেমন স্যুট টাই পরতে পারে, তেমনি লুঙ্গিও পরতে পারে। তারা এসির নিচেও থাকতে পারে, আবার টাকফাটা গরমে শীতল পাটিতে শুয়েও থাকতে পারে। তারা যেমন প্রাইভেট কার চরতে পারে, তেমনি ৮:৮ এর লোকাল বাসের ভিড়েও দাঁড়িয়ে যেতে পারে। তারা যেমন চিকন চালের ভাত খেতে পারে, তেমনি মোটা চালেরও ভাত খেতে পারে।
.
তারপরও মধ্যবিত্তরা স্বপ্ন দেখে। হাজারো স্বপ্ন। রঙ বেরঙের স্বপ্ন। বেঁচে থাকার স্বপ্ন। আমার মায়ের কিছু কথা বলছি যেটা দেখে আপনারা বুঝতে পারবেন, মধ্যবিত্তরা কতোটা স্বপ্ন প্রিয়। "বাবা, তুই যখন প্রথম বেতন পাবি, তখন তোর খালা আর দাদিকে শাড়ি কিনে দিবি।" "বাবা, তুই যখন প্রথম বেতন পাবি, তখন অনেক দামী দুটা গরু কুরবানী দিস" "তুই বড় হলেও বড় একটা বাসা বানাবি। সেখানে বারান্দা থাকবে। দামি দামি জিনিসপত্র থাকবে। আর একটা বাগান থাকবে।" "তুই প্রথম গাড়ি কিনলে আমাকে গাড়ি করে স্কুলে দিয়ে আসবি। সবাই দেখবে। আমি বলবো আমার ছেলে।" "তুই ডাক্তার হলে আমার আর ওষুধ খেতে হবে না।" "তুই বড় হলেই আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারবো।" "আমার খুব শখ তোর সাথে হজ্ব করবো।" "তোর প্রথম বেতন পেলেই আমি বড় রেস্টুরেন্ট এ খাবো, তার আগে নয়।" "এখন যেরম তোকে আমি মোবাইল কিনে দিসি, তুইও তোর ভাইকে কিনে দিবি।"
এরপরেও আমরা মধ্যবিত্ত। আমরা আমরাই। আমরা সুখী। আমরা ভেঙ্গে যাই। তবুও মচকাই না। আমরা কান্নাকে মুহূর্তেই হাসিতে পরিণত করতে পারি। আমরা সূর্যের নিচে দাঁড়িয়েও ভাবতে ভালোবাসি চাঁদ উঠবে। আমরা অথৈ সমুদ্রেও ভেসে থাকা ভেলা দেখতে পাই। জ্বি আমরাই মধ্যবিত্ত। জাহিদ সারওয়ার সুমনের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/মহসিন