মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে হওয়ার কন্টক মুকুট মাথায় নিয়ে জন্মাবার মতো বালাই জগতে আর দ্বিতীয়টা নাই। এর জন্য অনেক কিছু স্যাক্রিফাইজ করা লাগে। অনেক কিছুর সাথে কম্প্রমাইজ করা শেখা লাগে। মধ্যবিত্ত বাবা-মা কিছু পারুক আর না পারুক স্বপ্ন দেখতে পারে প্রচুর। স্বপ্ন দেখে তাদের বড় ছেলে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সুদিন ফিরিয়ে আনবে। তারা শুধু স্বপ্ন দেখেই যায়। কিন্তু যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে তার সামর্থ্য টুকু আর বিচার করে না। অনেকেই এই এক্সপেক্টেশনের ভারে নুব্জ হয়ে পড়ে। আর দাঁড়াতে পারে না। স্বপ্ন ভঙ্গের দায়ে তারা ফ্যামিলির জন্য ‘বোঝা’ হয়ে উঠে।
জীবনের কঠিন হিসাব-নিকাশের মার প্যাঁচে পড়ে বড় ছেলে গুলো এক সময় জীবন্ত ক্যালকুলেটর বনে যায়। তাদের প্রোগ্রামার বাবা-মা। তারা দেখে বাবা মানুষটা কী অমানবিক খাটুনি খেটে টাকা উপার্জন করছে। দেখে স্বল্পশিক্ষিত মা কেমন দক্ষতার সাথে যোগ-বিয়োগ, গুন-ভাগ করে প্রতিটা টাকা গুনে গুনে খরচ করছে। কোনো আজেবাজে খরচ নাই। অর্থের অর্থ মধ্যবিত্ত বাবার বড় ছেলেরা খুব ভালো ভাবে জানে। একটা সময় যে বাবার কাছে ক্যান্ডি কেনার জন্য দুই টাকা চাইতে দ্বিতীয়বার ভাবা লাগত না বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই বাবা অচেনা হয়ে যায়। একটা খাতা কেনার টাকা কিংবা যাতায়াত ভাড়া চাইতেও নিজেকে ছোট মনে হয়। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দীক্ষা বড় ছেলে গুলো এখান থেকেই পায়। তারা বুঝতে শেখে যে বাবার কাঁধে আর বেশি দিন ঝুলে থাকা যাবে না। এবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সেভিংস ব্যাপার টা এরা ভালো বুঝে। টাকা পয়সার ব্যাপারে মধ্যবিত্তের বড় ছেলেরা অন্যদের চাইতে অনেক আগেই ম্যাচিউরড হয়।
অন্য বন্ধুরা যখন মোবাইলের এইট মেগা পিক্সেল ফ্রন্ট ক্যামেরা দিয়ে সেলফি তোলে তখন তারা পকেটে রাখা মোবাইলটা সযত্নে নেড়ে দেখে যে, সব ঠিক ঠাক আছে কিনা। সেই মোবাইলে ফ্রন্ট ক্যামেরা দূরে থাক ব্যাক ক্যামেরার জন্যও কোনো ছিদ্র থাকে না। এমন না যে বাবা কে বললে একটা ভালো মোবাইল কিনে দিবে না। আজ না হয় কাল ঠিকই কিনে দেবে। কিন্তু বলতে সাহসে কুলায় না। তার মন সায় দেয় না। কারণ সে জানে একটা মোবাইল কেনার জন্য বাবা কে কয়েক মাসের বাজার খরচ থেকে টাকা বাঁচাতে হবে। টাকায় টান পড়বে। সে বাপের বড় পোলা। তার দায়িত্ব অনেক। এমনটা সে হতে দিতে পারে না। তার দায়িত্ববোধ তাকে বাঁধা দেয়।
একেকটা ঈদ হয়ে উঠে তাদের জন্য একেকটা মন খারাপের উপলক্ষ। মধ্যবিত্ত এমন হয় যে প্রাণ যায় তবুও মান যেন না যায়। তাই বাবা মা নিজেদের মান রাখতে আর ছেলের মন রাখতে হয়তো ঈদে একটা নতুন পাঞ্জাবী নিতে বলে। কিন্তু ছেলের মন বাঁধা দেয়। সে ম্লান হেসে বাবা মা কে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলে যে, গত ঈদের পাঞ্জাবীতেই তার চলে যাবে। তারা হঠাৎ করেই খুব সমাজবাদী হয়ে ওঠে। গলায় বিপ্লবী সুর নিয়ে এসে বলে, “যতদিন এইদেশের সব মানুষ ঈদের দিন নতুন জামা না পরতে পারবে ততোদিন আমিও ঈদে মার্কেট করব না।’পাঞ্জাবীটার বগলের ওখানটায় যে ছিদ্র হয়ে আছে তা আর বলে না। বললেই জোর করবে হয়তো। কী দরকার শুধু শুধু টাকা খরচ করানোর? কোনো এক সময় গিয়ে সেলাই করিয়ে ভালো মতো ধুয়ে আয়রন করে নিলেই হলো। ঈদ কাবার।
প্রেম করার জন্য মধ্যবিত্তের বর ছেলেরা পারফেক্ট চয়েজ। তারা ভালোবাসার মর্ম বোঝে। প্রিয় মানুষের প্রতি দায়িত্ববান হয়। কিন্তু সমস্যা হয় অন্যখানে। তাদের প্রেম চূড়ান্ত পরিণতি পর্যন্ত যেতে পারে না। কারণ ছেলের ওপর শুধু একটা মেয়েই না পুরো ফ্যামিলির দায়িত্ব এসে পড়ে। এই দায়িত্ব উপেক্ষা করে স্বার্থপরের মতো সে পালাতে পারে না। জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে নিজ পায়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে অনেক সময় লেগে যায়। একটা মেয়ে এতোদিন অপেক্ষা করতে পারে না। মনের অবাধ্য হয়েই ফ্যামিলির চাপে তাকে বিয়ে করতে হয়। মধ্যবিত্তের বড় ছেলে যখন চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় মেয়েটা তখন স্বামীর সংসারে পাক্কা গিন্নী বনে যায়।
তবে দিন শেষে বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত বাবার বড় ছেলেরাই জয়ী। এরা ভাল ফ্যামিলি ম্যান হয়ে ওঠে। ভাল বাবা, ভালো জীবন সঙ্গী। যারা বাবা মায়ের স্বপ্ন কে ভার হিসেবে না নিয়ে জীবন চলার কঠিন পথের অনুপ্রেরণা হিসেবে নেয় তারা লাইফে শাইন করে। ছোট বেলা থেকে পেয়ে আসা ট্রেনিং একটা পর্যায়ে এসে কাজে দেয়। জীবন চলার পথে হোঁচট খেতে খেতে শেখা ব্যাপারগুলো দিয়ে তারা বড় সমস্যার সমাধান করতে পারে। তারা অর্থ কষ্ট কাকে বলে তা উদাহরণ সহ বুঝে। তাই নিজ সন্তানদের আর সেই অভিজ্ঞতার মুখে ফেলে না। নিজের অতীত কিছুটা স্যাক্রিফাইজ আর কিছুটা কম্প্রমাইজ করে কাটলেও সন্তান আর জীবন সাথীর জন্য একটা ভালো ভবিষ্যত রেখে যেতে পারে। যে বাবা মা জীবন একদিকে আর ছেলের ভবিষ্যত একদিকে রেখে শত অভাবের মধ্যেও লেখা পড়া করিয়েছে তাদের জন্য একটা সুখকর শেষ বেলা এই মধ্যবিত্তের বড় ছেলেরাই উপহার দিতে পারে। এভাবেই কাটে মধ্যবিত্ত বাবার বড় ছেলেদের এইসব দিন রাত্রি। জীবনের জটিলতায় একেকজন হয়ে ওঠে জীবন যুদ্ধের ক্লান্ত কিন্তু বিজেতা যোদ্ধা।
মাহবুবুল হক নয়নের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/মহসিন