বিশ্বের সবচেয়ে বড় আইন বিষয়ক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে মোসাক ফোনসিকা। সেখান থেকে ১১.৫ মিলিয়ন গুরুত্বপূর্ণ ও গোপনীয় ফাইল ফাঁস হওয়ার ঘটনা অর্থাৎ 'পানামা পেপারস' এখন আলোচনার তুঙ্গে। একটি জার্মান পত্রিকার মাধ্যমে এ খবর প্রকাশ পায়। পত্রিকাকে এ খবরটি শেয়ার করে ইন্টারন্যাশনাল জনসর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)। এরা গার্ডিয়ান এবং বিবিসি-সহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে খবরটি প্রকাশ করে।
যা ফাঁস হয়েছে : পানামা পেপারসের মাধ্যমে ধনীদের ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার এবং অর্থ লুকিয়ে রাখার অসংখ্য উপায়ের সন্ধান দেওয়া হয়েছে। এসব ধনীদের মধ্যে ১২ জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নেতা এবং ১৪৩ জন নামকরা রাজনীতিবিদ রয়েছে। তারা এবং তাদের আত্মীয়-স্বজন বা নিজস্ব গণ্ডির মানুষরা দীর্ঘকাল ধরে ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার স্বর্গে বাস করছেন- এ সবই প্রকাশ পেয়েছে।
এ মানুষগুলোর মধ্যে এমন একজন আছেন যার সম্পর্ক সরাসরি রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে। সের্গেই রলডুগিন নামের মানুষটি পুতিনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। একটি স্কিমের মাধ্যমে রাশিয়ান স্টেট ব্যাংকের হিসাবের বাইরে ২ বিলিয়ন ডলার লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এর কিছু অর্থ দিয়ে স্কি রিসোর্টে ২০১৩ সালে পুতিনের মেয়ে ক্যাটরিনার বিয়ে হয়।
হিসাবের বাইরে লুকানো রয়েছে এমন অর্থশালীদের একজন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। আরো আছেন ইরাকের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আয়াদ আলাউই, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পরোশেনকো, মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্টের ছেলে আলা মুবারাক এবং আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সিগমুন্ডার ডেভিও গানলাগসন। এমন 'অন্ধকারের বিনিয়োগে ফান্ড' পরিচালনা করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন।
মোসাক ফোনসেকা : পানামা-ভিত্তিক আইন বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠান যা সম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে। এ ছাড়া এমন কিছু বিষয় আইনি সহায়তা প্রদান করে তারা যা কিনা গতানুগতিক ধারার বাইরে। যেমন- ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস। মূল ধারার বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আইনি সহায়তাও দেয় তারা।
কর্মক্ষেত্র : পানামার প্রতিষ্ঠান হলেও তাদের বিস্তৃতি গোটা বিশ্বে। এদের ওয়েবসাইটে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে ৪২টি দেশে ৬০০ জন মানুষ কাজ করছেন। এরা সুইজারল্যান্ড, সাইপ্রাস এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস-এ 'ট্যাক্স হেভেন' অপারেট করে।
অর্থের প্রবাহ : মোসাক ফোনসেকা প্রায় ২ লাখ প্রতিষ্ঠানের রেজিস্টার্ড ফার্ম হিসাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারা আইনের মাধ্যমে অন্তরালে থেকে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং সম্পদের মালিক। ট্যাক্স হেভেন হিসাবে এদের ক্লায়েন্টদের পছন্দের তালিকার মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, বাহামাস, পানামা, আফ্রিকা, সামোয়াসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চল।
মোসাক ফোনসেকা সাধারণত অ্যাকাউন্ট, ব্যাংক এবং ট্রাস্ট কম্পানির সঙ্গে কাজ করে। ইউরোপে তাদের সেবা সুইজারল্যান্ড, জার্সি, লুক্সেমবার্গ এবং ইউকে-এর মাধ্যমে প্রদান করা হয়।
সম্পদের মালিকরা সাধারণত নমিনির মাধ্যমে নিজের নামটি অনুচ্চারিত রাখতে চান। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে তাদের স্বাক্ষরও করতে হয় না। এরা মোসাক ফোনসেকার মাধ্যমে তাদের সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাদের ১৩ হাজার মানুষের তালিকা নমুনা হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে। চীন এবং রাশিয়া তালিকার শীর্ষে রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি কত বড়? : অফশোর সার্ভিসের জন্যে এটা বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ প্রতিষ্ঠান। এটা ৩ লাখেরও বেশি প্রতিষ্ঠানকে সেবা দিয়েছে। এদের অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ অ্যাডমিনিস্টারড ট্যাক্স হেভেনস-এর অধীকে সুবিধা নিয়ে থাকে।
কতটা তথ্য ফাঁস হয়েছে? : বিপুল পরিমাণ তথ্য ফাঁস হয়েছে। ২০১০ সালে উইকিলিস যত তথ্য ফাঁস করে তার চেয়ে অনেক বেশি তথ্য পানামা পেপারস-এ ফাঁস হয়েছে। একে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তথ্য ফাঁসের ঘটনা বলা হচ্ছে। ১১.৫ মিলিয়ন ফাইল প্রকাশ পেয়েছে যা রাখতে ২.৬ টেরাবাইট স্টোরেজ প্রয়োজন।
সম্পদশালী মানুষদের এই যে প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধা দেওয়া হয় তা বৈধ। সাধারণত অপরাধীদের হাত থেকে বাঁচতে নিজেদের সম্পদ লুকিয়ে রাখেন অর্থশালীরা। বেনামে অর্থ বা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সহায়তা করে মোসাক ফোনসেকা।
এই তথ্য ফাঁসের ঘটনায় মোসাক ফোনসেকা তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা অ্যান্টি-মানি-লন্ডারিং আইনের মাধ্যমে তাদের ক্লায়েন্টকে সেবা দিচ্ছেন। তারা এ ঘটনা খতিয়ে দেখছে এবং ভবিষ্যতে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তার জন্যে সাবধান থাকবে তারা। সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান
সেলিনা জাহান প্রিয়ার ব্লগ থেকে
বিবার্তা/মহসিন