ইদানিং মজার কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি, কেন আমি ভিনদেশে থেকে দেশ নিয়ে এতো কথা বলি। আবার এও শুনেছি, অনলাইনে কথা না বলে আমি যেন পারলে দেশে রাজপথে এসে রাজনীতি করতে যাই। আমি অবাক হয়ে যাই এসব প্রশ্ন আসছে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে।
আমি নিশ্চিত এসব নেতা কর্মীরা জানে না যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তথা সকল ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং সমাজতন্ত্র তথা শোষণমুক্ত সমাজ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হলো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মূলনীতি। যখনই আওয়ামী লীগের কোন নেতাকর্মীর কথা বার্তায় আচরণে উপরে উল্লেখিত কোন মূলনীতির লংঘন দেখা যায়, তখনই আমি এর প্রতিবাদ করবো।
আমি দেশে আছি কিংবা ভিনদেশে আছি এগুলা কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না আমার জন্য। আর আমি ইংল্যান্ডে কোন এসাইলাম ক্যাটেগরিতে বাস করছি না, এখানে একজন গর্বিত বাংলাদেশি হিসেবেই আছি। আর রাজপথের গল্প আমারে না শুনালেও চলবে। আমাকে যারা আপাদমস্তক চিনে তারা বুঝে কিভাবে রাজপথ কিংবা সাইবার-পথ- সবখানেই আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গর্বিত সৈনিক। আমি দেশে আসলেই আমাকে চাপাতি দিয়ে কোপাইয়া মারবেন বলে যদি ভেবে থাকেন, তারাও বোকার রাজ্যে বাস করছেন। আমি নিজেকে রক্ষা করতে শিখেছি এবং সেটা ভালোভাবেই শিখেছি।
নিজের কৈফিয়ত বাদ দিয়ে এবার কাজের কথায় আসি। সম্প্রতি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ‘হস্তক্ষেপ চেয়ে’ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতা রানা দাশগুপ্তের কথিত বক্তব্য নিয়ে জাতীয় সংসদে প্রশ্ন তুলেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আব্দুল মজিদ খান। সম্মানিত সংসদ সদস্য এমন সময় এই মন্তব্য করেছেন যখন এক হিন্দু শিক্ষককে হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত সন্ত্রাসী ফাহিম পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে মারা যায়।
কেন তাদের এমন হত্যা মিশনে নামানো হয়েছে প্রশ্নের জবাবে ফাহিম পুলিশকে জানিয়েছে, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারতকে বিক্ষুব্ধ করে তুলতেই তাদের দিয়ে হিন্দু পুরোহিতসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনকে হত্যা করানো হচ্ছে। নির্দেশ দাতাদের মতে, ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন নিয়ে এ সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে। তাই ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত অঞ্চলকে বেছে নিয়ে সংখ্যালঘু হত্যার মাধ্যমে ভারতকে ক্ষুব্ধ করতে না পারলে কোনোভাবেই এ সরকারকে বিদায় করা যাবে না। আর তাদের এ মিশন সফল হলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে জামায়াত-শিবির।’
বড় পরিকল্পনাটা হয় অনেকটা এমন যে হিন্দুদের নামে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ (যেমন বছর কয়েক আগে থেকেই ছড়ানো হচ্ছে যে, দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে হিন্দুদের বসানো হয়েছে), ভারতপ্রীতির অভিযোগ (এই যেমন রানা দাশগুপ্তর নামে কথিত সাহায্যের প্রার্থনার অভিযোগ) তোলা হতে থাকে। এসব বলে হিন্দুদেরকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেবার চেষ্টা করা হয়, যাতে তারা কখনও মুখ খোলার চিন্তাও না করে। চরিত্রহননের চেষ্টা চলতে থাকে, যাতে চরিত্রহননের পরে হনন করতে সুবিধা হয়।
এরপরে হিন্দুদের উপরে আক্রমণ করা হতে থাকে। হত্যা করা হয়, ধর্ষণ করা হয়, জমি ভিটেমাটি লুণ্ঠন করা হয়, প্রতিমা ভেঙ্গে ফেলা হয়, মন্দির ভাংচুর বা পুড়িয়ে দেয়া হয়। হিন্দুরা কথা বলবে কিভাবে? তাদের তো মুখ বন্ধ করে দেয়া আছে।
আক্রমণগুলো মাঠ পর্যায়ের বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীরা করলেও বিএনপি-জামায়াতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দই এই স্ট্র্যাটেজি নির্ধারণ করে দেয়। হিন্দুদের নামে অপপ্রচারের দায়িত্ব দিয়ে দেয় সমাজের বিভিন্ন স্তরে লুকিয়ে থাকা বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের। এরা সমাজে এসব প্রচার করে থাকে এবং হিন্দুদেরকে অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। এমনটা তো আমরা সেই কবে থেকেই দেখে এসেছি। কিন্তু হিন্দুদের উপরে আক্রমণের ঘটনা সাজাতে যদি আওয়ামী লীগের নেতা জড়িত হয়ে যায়, তাহলে আর বলার কি থাকতে পারে? যেমন হবিগঞ্জ ২ আসনের সংসদ সদস্য হিন্দুসমাজের চরিত্রহনন করছেন। রানা দাশগুপ্তর নামে আজব গুজবের ভিত্তিতে কথিত দেশদ্রোহিতার কাল্পনিক অভিযোগ এনে আব্দুল মজিদ খান বিএনপি-জামায়াতীদের ঝুলিতে নতুন যুক্তি দিয়েছেন যে, ‘আওয়ামী লীগের এমপি বলছে, হিন্দুরা ভারতপ্রেমী’। ফলে, হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িকদের আক্রমণে আগে যারা প্রতিবাদ করতো, সম্ভাবনা আছে, তারা অনেকে এখন নীরব থাকবে।
অন্য অনেকে বললে ব্যাপারটি এক রকম থাকে, আর আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বললে ব্যাপারটি অন্য রকম হয়ে যায়- এটি সবাই বোঝে। কিন্তু বোঝেন না আব্দুল মজিদ খান। বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, তার মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হয়ে যাচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার দিকে বাংলাদেশকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এসব শুধু হিন্দু সম্প্রদায়কেই ক্ষতি করছে না, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
মাননীয় সংসদ সদস্যের কাছে আমার দাবি, নিজের ভুল বক্তব্যের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। এতে আদতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগেরই সুনাম রক্ষিত হবে।
সুশান্ত দাস গুপ্তের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া