বিধবার সামাজিক সংজ্ঞা যাই হোক না কেন, কলকাতা থেকে ২০০৫ সালে প্রকাশিত (দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০০৬) অভ্র বসুর ‘বাংলা স্ল্যাং সমীক্ষা ও অভিধান’-এ বিধবার যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে, তাতে আমি ‘বিধবা’ না হয়ে পারিনি। কারণ অভিধানটিতে বিধবা শব্দের অর্থে বলা হয়েছে ‘যে পুরুষের নারী বন্ধু নেই।’
বাজার চলতি অভিধানগুলোতে বলা হয়েছে, বিধবা মানে যে নারীর ধব বা স্বামী মৃত, পতিহীনা, মৃতভর্তৃকা। শব্দটির গঠন হচ্ছে সংস্কৃত বি + ধব + আ।
আমার বিধবাত্বের যুগ শুরু হয়েছে দেখে প্রথমে মনে কষ্ট পেলেও পর মুহূর্তেই মনে পড়ে গেলো, ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক ইতিহাস বিধবাদের করুণ যাতনার কাহিনী ছাড়া রচিত হতে পারে না।
সহমরণের মতো একটা অতি বর্বর প্রথাকেও নতমস্তকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য হয়েছিল বিধবারা। অথচ বৈদিক সমাজে বিধবা বিবাহ ছিল একটি সর্বজন স্বীকৃত সামাজিক বিধান। যে নারীর স্বামী মারা গেছে, সে তার প্রতি আগ্রহী যে কোন পুরুষকে দ্বিতীয় স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারতো। এটা তো কলঙ্ক ছিলই না। তার উপর সমাজপতি বা বৈদিক ঋষিরা নারীকে পুনর্বিবাহের জন্য উৎসাহিত করেছেন এভাবে: ‘হে নারী উঠে এসো, তুমি যে পুরুষের গাত্রলগ্না হয়ে আছ সে মৃত। মৃত স্বামীকে ছেড়ে সংসারে ফিরে এসো। যে পুরুষ সাগ্রহে তোমার পাণিপীড়ন করবে তাকে স্বামী রূপে গ্রহণ কর’ (১০ মণ্ডল ১৮ সূক্ত, ঋগ্বেদ)। এ সূক্তে ‘দ্বিধিষু’ শব্দটি এসেছে। শব্দটির অর্থ দ্বিতীয় স্বামী বা যে পুরুষ বিধবাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছে।
বৈদিক সমাজে যে নারী বৈধব্য বরণের পরে পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতো তাকে বলা হতো ‘পরপূর্বা’। আর এ বিবাহের মাধ্যমে যে পুত্র জন্ম নিতো তাকে বলা হতো ‘পুনর্ভব’।
ঋগ্বেদের কোথাও সতীদাহ প্রথার উল্লেখ নেই। কোথাও গতাসুভর্তার অনুগমন করবার উপদেশও নেই। গবেষক আবি আবদুল্লাহ তাঁর ‘প্রসঙ্গ: সংস্কৃতি আর্য বনাম অনার্য’ বইতে লিখেছেন, ‘ঋগ্বেদের একটি শব্দের সামান্য বিকৃতির মাধ্যমে এই নিদারুণ ব্যবস্থাটি সহস্রাধিক বছর টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। ‘আরোহন্তু জনয়: যোনিং অগ্র’ এই ঋকটির শেষ শব্দ ‘অগ্রে’র স্থলে ‘অগ্নে’র শব্দটি পাঠ করে সতীদাহকে শাস্ত্রসম্মত করা হয়।
কোন ব্রাহ্মণ কোন কুগ্রহের প্রভাবে পড়ে এ কাজ প্রথম করেছিল ইতিহাসে তার নাম লেখা নেই। কিন্তু এই ভ্রান্তির জালে পড়ে মানবজাতির ইতিহাসের এক করুণতম অধ্যায় রচিত হয়েছিল। একটি শব্দের বিপাকে পড়ে কোটি কোটি নিরপরাধ নারী অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতি দিয়েছিল।
উল্লেখ্য, আর্য সমাজে বাল্যবিবাহ প্রথার প্রচলন ছিল না। পরে হিন্দু সমাজে ধর্মের নামে এ অবৈদিক প্রথাটি চালু হয়। আর গৌরীদানের কোপানলে পড়ে লাখো কিশোরীর কপালে দুর্গতি নামে’।
এ কথার সমর্থন পাওয়া যায় নগেন্দ্রনাথ বসুর বাংলা বিশ্বকোষেও।
জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া