ভদ্র শব্দটি এক সময় বহুরূপী ছিল। সময়ের ব্যবধানে শব্দটির বাড়তি রূপগুলো শীতের পাতাঝরার মতো ঝরে গেছে। কিন্তু ইতিহাস যে রয়ে যায়!
ভদ্র শব্দটির মূল সংস্কৃত। এটার গঠন হচ্ছে: ভন্দ্ + র, ন লোপ। শব্দটির মূলে ভন্দ্ ধাতু রয়েছে। ভন্দ্ মানে কল্যাণ।
সংস্কৃতে বিশেষণ হিসেবে ভদ্র অর্থ কল্যাণকর, শ্রেষ্ঠ, নিপুণ, প্রশস্ত, সাধু, মনোজ্ঞ, কান্ত।
আবার সম্বোধনে প্রিয়, সাধু ও মিত্রভাবাপন্ন। অন্যদিকে পুংলিঙ্গে শিব (ভদ্রকাব্য মানে শিবের কাব্য) খঞ্জন, বৃষভ, করি জাতিবিশেষ, যে গোপনে পাপ করে ও বাইরে সদাকারে তা প্রচ্ছন্ন রেখে পরদ্রব্যগ্রহণ করে, কদম্ব, স্নুহী বৃক্ষ, চন্দন, দেবদারু, সুমেরু, জিনবিশেষ।
অন্যদিকে সংস্কৃতে কীবলিঙ্গে ভদ্র মানে মঙ্গল, শুভ, বিপ্রবাক্য, শুভকর বিষয়, হিত, ভদ্রমুথা, কাঞ্চন। আবার জ্যোতিষশাস্ত্রে ভদ্র হচ্ছে সপ্তম করণ। কিন্তু বাংলায় ভদ্র মানে সদ্বংশজাত ব্যক্তি।
তবে বাংলায় ভদ্র শব্দটির অর্থ সব সময় একই জায়গায় স্থির থাকেনি। শ্রেষ্ঠ, উত্তম, ভাল, মঙ্গল অর্থে ভদ্র শব্দটি এক সময় ব্যবহৃত হতে।
বিশেষত এককালে গ্রামের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বা গ্রামবাসীর নির্বাচিত ব্যক্তিই ‘ভদ্র’ ছিলেন। বর্তমানে ভদ্র মানে সভ্য, শিষ্ট, সংস্কৃতিমনা, রুচিশীল।
বৈদিক যুগে নিরুক্ত বা শব্দশাস্ত্রে ভদ্র শব্দটি দিয়ে গৃহ, প্রজা, পশু, বিত্ত ইত্যাদি নির্দেশিত হতো। মধ্যযুগেও নানা অর্থে ভদ্র শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
অভিধানে থাকলেও মহাদেব, বলরাম, রামের অনুচর, দিগগজ, খঞ্জন পাখি, শ্রীকৃষ্ণের লীলাকানন, ষাঁড়, সাধু, সৌভাগ্য, শুভ, ক্ষৌর (ভদ্র কর, ছাড় এ মলিন বসন- চৈতন্যচরিতামৃত), দেউল, ইতর, প্রধান অর্থে শব্দটির প্রয়োগ আর নেই।
হিন্দুশাস্ত্র মতে, আবার ভদ্র মানে কল্যাণ। মানবজীবনে সাধারণত কল্যাণ চারটি- ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ।
অন্যদিকে পঞ্চভদ্র বলতে বোঝায় পাঁচটি শুভচিহ্নকে। যে অশ্বের মুখ, পৃষ্ঠ, বুক ও দুইপার্শ্ব- এ পাঁচস্থানে শুভ লক্ষণসূচক আবর্ত আছে তা পঞ্চভদ্র নামে অভিহিত। কথিত হয় এরূপ অশ্ব দেখে যাত্রা করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ১১টি উপাদানকে ভদ্র বলা হয়। যেমন স্বর্ণ, লোহা, নীলপদ্ম, চন্দন, কদম, স্নুহীগাছ, মুস্তক, নাগরমুখা, ইন্দ্রযব, দেবদারু ও সরল দেবদারু।
ভদ্রের স্ত্রীলিঙ্গ ভদ্রা। ভদ্রা শব্দটি দিয়ে এখন সুশীলা বা মার্জিত রুচির নারী বোঝালেও শব্দটি এক সময় অভিমন্যুর জননী সুভদ্রা, সূর্য্যকন্যা, উত্তর কুরুবর্ষে প্রবাহিত গঙ্গাস্রোত, আকাশগঙ্গা, মিষ্টি, অবশিষ্ট তিন দণ্ড, দ্বিতীয়া সপ্তমী ও দ্বাদশী তিথি অর্থে ব্যবহৃত হতো।
আবার আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে ১৪টি উপাদান ভদ্রা নামে পরিচিত। যেমন অনন্তা, জীবন্তী, কাকডুমুর, শমী, কটফল, গাম্ভারী, নালী, অপরাজিতা, হরিদ্রা, সুতা, রাস্না, বচ, শ্বেত দুর্বা ও দন্তী।
জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া