ব্যুৎপত্তির দিক থেকে ফলাফল অর্থে ফলশ্রুতি শব্দের প্রয়োগ শুদ্ধ নয়। কিন্তু চলতি অর্থে ফলশ্রুতির অর্থ ফলাফল মেনে নেয়া যেতে পারে। কারণ বুৎপত্তির দিকে তাকালে ‘শুশ্রুষা’, ‘মুমূর্ষু’ ইত্যাদি শব্দের চলতি প্রয়োগও অশুদ্ধ হতে বাধ্য। ইংরেজি ভাষায়ও এ জাতীয় ভূরি ভূরি শব্দ রয়েছে। যেমন restive এর প্রাথমিক অর্থ ছিল at rest. বর্তমানে প্রাথমিক অর্থের একেবারে বিপরীতে restless অর্থে ব্যবহৃত হয়।
ফলাফল অর্থে ফলশ্রুতির প্রচলন দেখে ভাষাবিদ বিজনবিহারী ভট্টাচার্য বেশ আশাম্বিত হয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, শব্দটি আভিধানিক স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু পায়নি।
ফলাফলকে ফল অর্থে অশুদ্ধ ধরলে আরেকটি মৌলিক প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যেতে পারে। আর তা হচ্ছে ‘ফলাফল’ শব্দটি বাংলায় শুদ্ধ হয় কি করে?
সন্ধি বিচ্ছেদের নিয়মে ফল + অফল = ফলাফল। আমরা ফলাফলকে ফল অর্থে ধরে নিলে ‘অফল’ কোথায় যাবে? চলাচল (চল + অচল), যোগাযোগ (যোগ + অযোগ), মালামাল (মাল + অমাল), গালাগাল (গাল + অগাল) ইত্যাদি শব্দের ব্যবচ্ছেদ করার পর বিপরীত ধরনের যে দুটি করে শব্দ পাই, আমরা কি বাংলায় সেই অনুসারে শব্দগুলির অর্থ তালাশ করি?
‘যোগাযোগ’ শব্দটির কথাই ভাবুন। এ শব্দটি সম্পর্কে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, ‘শব্দটা বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত। এর আক্ষরিক অর্থ কিন্তু অন্য রকম। যোগাযোগের অর্থ হলো যোগ + অযোগ = যোগাযোগ অর্থাৎ stars in your favours and stars not favourable এ দুইয়ের ফলে পাল্লা যে দিকে ভারী হয় তার প্রতিক্রিয়া। তুমি যদি বল তার সাথে আমার যোগাযোগ হল এটা ব্যাকরণগত দিক দিয়ে ভুল। তোমার বলা উচিত তার সাথে যোগাযোগের ফলে আমার দেখা হলো। তার অর্থ stars তোমার পক্ষে যাওয়াতে তার সাথে তোমার দেখা হল। কিন্তু অন্য অর্থে শব্দটি বাংলা ভাষায় জাকিয়ে বসেছে। একেই বলে ভাষার শক্তি, এটাই সজীবতার লক্ষণ।’
তাই ফল অর্থে ফলশ্রুতির প্রয়োগকে অশুদ্ধ সার্টিফিকেট হয়তো দিয়ে ফেলা যায়। শব্দটির পাপগুলো নিয়ে নাতিদীর্ঘ গবেষণাপত্রও উপস্থাপন করা যেতে পারে। শব্দটিকে নির্বাসন দণ্ডও দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে ভাষার গতিশীলতা যে নষ্ট হবে! ব্যুৎপত্তিগত অর্থ দিয়ে চলতি শব্দ শুদ্ধ করতে চাওয়াটা সঠিক কাজ নয়।
ফলশ্রুতি শব্দটি দিয়ে অনেকে ফল বোঝাতে চান। অনেকে আবার ফল অর্থে ফলশ্রুতির ব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার (বিশেষত মিডিয়াম্যানরা, আমিও কিন্তু মিডিয়াম্যান)। কিন্তু ফলশ্রুতিতে ফল অর্থে ব্যবহারে দোষ দেখেন না, এমন প্রাজ্ঞজনও রয়েছেন।
ফলশ্রুতির মূলানুগ অর্থ ‘কোনো পূর্ণকর্ম করলে যে ফল হয়, তা শোনা বা তার বিবরণ’ অথবা ‘পুণ্যকাহিনী শ্রবণে যে ফল পাওয়া যায়, তা-ই ফলশ্রুতি।’ সোজা কথায়, মহাভারত কিংবা গীতা শ্রবণের শ্রুতিফল হচ্ছে পুণ্যলাভ, অতএব ফলশ্রুতি হচ্ছে পুণ্যার্জন কিংবা ধর্মাভাবের উন্মেষ।
বলা যায়, ফললাভের পূর্বপরম্পরাগত বাক্যই ফলশ্রুতি। যেমন ‘পুত্রার্থী লভতে পুত্রং ধনার্থী লভতে ধনং’ - অর্থাৎ এই গীতা পাঠ করলে বা এই যজ্ঞাদি করলে পুত্রার্থী পুত্রলাভ ও ধনার্থী ধনলাভ করে থাকেন- এই ফল নির্দেশ করাকে ফলশ্রুতি বলে।
অথচ ফলাফল অর্থে শব্দটির প্রয়োগ নিয়ে কারো কারো আপত্তি থাকলেও বিজ্ঞজনেরা শব্দটি ফলাফল অর্থেই সাবলীলভাবে ব্যবহার করে গেছেন। সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘শবনম্’ গ্রন্থের বাংলাদেশী সংস্করণের ভূমিকায় বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ এনামুল হক লিখেছেন, ‘পাঠান্তে এইবার বইটির ‘ফলশ্রুতি’ হৃদয়ে রেখাপাত করিল, তাহা হইল- অদ্ভুতত্বের বাস্তব অভিব্যক্তিজ্ঞাপক একটি ছোট প্রশ্ন, ‘শবনম্’ কি?।’
আর ভারতীয় গুণীজন ও সংস্কৃত পণ্ডিত করুণাসিন্ধু দাস তাঁর '‘সংস্কৃত ব্যাকরণ ও ভাষা প্রসঙ্গ’ গ্রন্থে শব্দটি সাবলীলভাবে ব্যবহার করেছেন, ‘বাক্যাংশ বিশ্লেষণ করতে বসে মৌলিক উপাদান হিসাবে প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের আবিষ্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যুক্তিসিদ্ধ ফলশ্রুতি, সন্দেহ নেই।’
শব্দটির প্রয়োগগত দিক নিয়ে বাংলা ভাষার মেজো কর্তাদের এতোটা বিরাগের কারণ জানা যায়নি।
জিয়াউদ্দিন সাইমুমের ব্লগ থেকে
বিবার্তা/জিয়া