যেভাবে গণমানুষের মাধ্যম হয়ে উঠল ফেসবুক

যেভাবে গণমানুষের মাধ্যম হয়ে উঠল ফেসবুক
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০১৬, ১৮:১১:৪৭
যেভাবে গণমানুষের মাধ্যম হয়ে উঠল ফেসবুক
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+
জনমত তৈরি থেকে সাধারণ একজন মানুষকে তারকা বানিয়ে দেওয়া, দেশের রাজনীতি আর মিডিয়ার পরিচিত চেহারা বদলে দেওয়া - এভাবেই বাংলাদেশে জনমাধ্যম হয়ে উঠেছে ফেসবুক।
 
খুলনা শহরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে আপনার কানে মাইকেল জ্যাকসনের পরিচিত কোনো গানের সুর ভেসে আসতেও পারে। গানের উৎস খুঁজতে একটু এগিয়ে গেলে হয়তো আরও চমকে উঠবেন। সাদা শার্ট, আঁটসাঁট কালো প্যান্ট, গলায় টাই, মাথায় সেই পরিচিত কালো টুপি। পপসম্রাট নিজে খুলনা শহরের ধুলোমাখা রাস্তায়! নিজের বিখ্যাত ‘মুনওয়াক' করে বিক্রি করছেন চানাচুর!
 
গত বছর সেপ্টেম্বরে খুলনার চানাচুর বিক্রেতা বিল্লালকে নিয়ে এমনই একটা ভিডিও আমি পোস্ট করেছিলাম ফেসবুকে। সেই ভিডিও এরই মধ্যে শেয়ার হয়েছে এক লাখের বেশি বার। ভিডিওটি যাঁরা শেয়ার করেছেন, তাঁদের মধ্যে আছেন মাসুদ রানার স্রষ্টা, কিংবদন্তি লেখক কাজী আনোয়ার হোসেনও। এভাবে বাংলাদেশের এক প্রান্তের শহরের প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষ বিল্লাল পৌঁছে গেছেন পুরো বিশ্বের মানুষের কাছে। ১৮ লাখেরও বেশি বার দেখা ভিডিওটিতে মন্তব্য করেছেন ইউরোপ-অ্যামেরিকার ভিনদেশি অনেকেও। বিল্লাল এরই মধ্যে বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রধান টিভি চ্যানেলে এসে অনুষ্ঠানও করেছে গেছেন।
 
কিংবা কক্সবাজারের আট বছরের সেই শিশু জাহিদ, সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের মাথা মালিশ আর নানারকম গান শুনিয়ে দিন চলত যার। তার একটি গান ‘মধু খই খই...' বদলে দিল জীবন। ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা মোহাম্মদ ইমরান হোসেন ও তাঁর পাঁচ বন্ধুর করা ভিডিওর কল্যাণে জাহিদ পৌঁছে গেল লাখো মানুষের কাছে। জাহিদ এখন কক্সবাজারেরই নামকরা একটা হোটেলে চাকরি করে, গান শোনায়। পাশাপাশি স্কুলেও যায়।
 
একটু ঠাট্টার ছলে হলেও ‘হিরো আলম' নামের বগুড়ার একজন সাধারণ তরুণ দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে তাঁর মতো মানুষও পৌঁছে যেতে পারে সবার কাছে, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে।
 
ফেসবুক কিংবা ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো এভাবেই বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে জনমানুষের মাধ্যমে। তথ্যপ্রযুক্তির সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক শক্তি বোধহয় এটাই।
 
আগে মিডিয়ার আসল ক্ষমতা ছিল কিছু মানুষের হাতে। সেখানে খবরও প্রকাশিত হতো কিছু মানুষের। ‘কিছু মানুষের’ এই বৃত্ত ভেঙে দিয়েছে সামাজিক মাধ্যম। খুব সহজভাবে ভাবুন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘মিডিয়া', যে মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ, সেখানে আপনার-আমার ব্যক্তিগত খবর, জন্মদিন কিংবা বিয়ের ছবি প্রকাশিত হচ্ছে।
 
বিশ্বে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম বেশ ক’টি। যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত ফেসবুকই মূলত গণমানুষের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। টুইটার এখনো সে রকম অবস্থান বা ভূমিকা রাখতে পারেনি। আর আছে ইউটিউব।
 
ফেসবুক আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে ডায়েরির মতো। আমরা সেই ভার্চুয়াল ডায়েরিতে লিখছি। পার্থক্য হলো, নিজের ব্যক্তিগত দিনলিপি আমরা হয়তো লুকিয়ে রাখতাম। কিন্তু আমরা ফেসবুকে আমাদের কথা ছড়িয়ে দিচ্ছি। ছড়িয়ে দিচ্ছি আমাদের ভাবনা, আমাদের মতামত। সেই ভাবনা বা মতামত কখনো কখনো শুধু ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির মধ্যে আটকে থাকছে না। আমরা বলছি, দেশ ও সমাজ নিয়ে। বলছি বিশ্বকে নিয়েও।
 
আমি নিজে একজন সংবাদকর্মী। ১৪ বছর ধরে বাংলাদেশের শীর্ষ একটি সংবাদমাধ্যমে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, সামাজিক মাধ্যমগুলোকে এখনো বিকল্প মাধ্যম বলা হলেও ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমগুলোই মূল হয়ে উঠছে যেন। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনাগুলোর সঙ্গে সামাজিক মাধ্যম সরাসরি জড়িয়ে আছে, গণজাগরণ মঞ্চ সেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত। 
 
একদম অচেনা একজন মানুষের ছোট্ট একটা ফেসবুক ইভেন্ট কী করে সারা বাংলাদেশে আক্ষরিক অর্থেই নতুন একটা গণজাগরণ তৈরি করতে পেরেছিল, ভাবতে এখনো অবাক লাগে। অবাক লাগে এই ভেবেও, সেই আলোড়ন, সেই উত্তুঙ্গ আবেগের স্রোতটাকে কী করে ধরে রাখা গেল না এই ভেবেও।
 
গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষে-বিপক্ষে তাই আছে নানা আলোচনা। তবে একটা সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে কীভাবে একদম সাধারণ মানুষ ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা রাজনীতিকেও টলিয়ে দিতে পারে, এটার উদাহরণ হয়ে থাকবে অবশ্যই। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এই ঘটনার পরই বাধ্য হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কথাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে। স্কুলপড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর কথা শুনে তাই যোগাযোগমন্ত্রীকেও আমরা দ্রুত উদ্যোগ নিতে দেখেছি। এই ঘটনা দেশের মূল ধারার সংবাদমাধ্যমকেও বাধ্য করেছে সামাজিক মাধ্যম সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে। 
 
মিডিয়া এখন আর একমুখী নেই। শুধু সংবাদমাধ্যম বলবে আর এর পাঠক, শ্রোতা, দর্শক শুনবে - তা হবে না। মিডিয়াকেও এখন পাঠক, শ্রোতা, দর্শকের কথা শুনতে হবে। তাদের সেই মতামত, মন্তব্য প্রকাশ করতে হবে।
 
 
সামাজিক মাধ্যমের সবচেয়ে বড় শক্তির আরেকটি দিক দেখা গেল ১ জুলাই গুলশানের রক্তাক্ত ঘটনার পর। পুলিশ খুঁজে বের করার আগেই ফেসবুক ব্যবহারকারীরাই আইএস প্রকাশিত ছবি ধরে ধরে মিলিয়ে প্রায় সব জঙ্গির নাম-পরিচয় বের করে ফেলেছিল। পুলিশ এরপরও আকাশ, বিকাশ, ডন, বাঁধন, রিপন নাম দিয়ে জঙ্গিদের পরিচয় করিয়ে দিলে এ নিয়েও তীব্র সমালোচনা উঠেছিল ফেসবুকে। পুলিশ বাধ্য হয়েছিল নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে।
 
এ সবই ফেসবুকর ইতিবাচক দিক। খারাপ দিকও কি নেই? গুলশান ট্র্যাজেডির ওই সময়টাতেই ফেসবুকের অন্ধকার দিকটির চেহারা দেখা গেছে। যেখানে বন্ধুর জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা ফারাজকে নিয়ে একটা দীর্ঘ সময় অপপ্রচার চলতে দেখা গেছে।
 
ফেসবুক কখনো কখনো সেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল'-এর ভূমিকাও নিয়ে ফেলছে। প্রমাণ হওয়ার আগেই ফেসবুক অনেক সময় জনমত তৈরি করে ফেলছে কারও বিরুদ্ধে। কারও কারও কাছে ফেসবুক ‘যা ইচ্ছে তা-ই' লেখার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। অভিযোগ আছে, কিছু কিছু বড় ফেসবুক গ্রুপ, ফেসবুকের কল্যাণে তারকা হয়ে ওঠা ‘ফেসবুক সেলেব্রিটি' রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে এই মিডিয়া ব্যবহার করছেন। কিছু রাজনৈতিক দল বা সংগঠন ‘পেইড ফেসবুকার' ব্যবহার করে জনমত প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ শোনা যায়।
 
ফেসবুকে কখনো কখনো গুজব, বানোয়াট ফটোশপ করা ছবি, এমনকী কারসাজি করা ভিডিওও ভাইরাল হতে দেখা যাচ্ছে। অসৎ উদ্দেশ্যে ফেসবুক ও এর শক্তিকে ব্যবহার করতে অনেকেই সাময়িকভাবে সফলও হয়েছেন। গুজব ও মিথ্যা কথা দাবানলের মতো ছড়িয়েও গেছে। কিন্তু ফেসবুক এখন যে নেটিজেন জার্নালিজমের ভূমিকা পালন করছে, তাতে এমনও অনেক সময় দেখা গেছে, মিথ্যা অপপ্রচার বেশিক্ষণ ধোপে টেকেনি। পাল্টা যুক্তি দিয়ে, তথ্যপ্রমাণ দিয়ে অনেকেই মিথ্যা ও অপপ্রচারের সেই দাবানল নিভিয়ে দিয়েছে।
 
শুধু সমস্যা একটাই মনে হয়, কখনো কখনো ভাষার ব্যবহারে আমরা সংযত থাকি না। আমরা বুঝতে পারি না, সামাজিক মাধ্যমে আমরা কারও সমালোচনা করলেও সেটির ভাষা শালীন রেখেই সমালোচনা করা যায়। কখনো কখনো আমরা খুব সহজেই অন্যের মতামতে প্রভাবিত হই। সেই মতটা আসলেই ঠিক কি না, যাচাই করি না। এমনও দেখেছি, একই বিষয়েরই পক্ষে-বিপক্ষে যখন ফেসবুকে আলোচনা হয়; এমন অনেকেই আছে, দুই পক্ষের পোস্টেই লাইক দিচ্ছে!
 
সম্প্রতি রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি উচিত কিনা, এমন বিতর্কেও এই অভিজ্ঞতা আমার হলো। আমার ফেসবুকে আছেন এমন বেশ কজনকে দেখলাম, পক্ষের বক্তব্যেও লাইক দিচ্ছেন, বিপক্ষের বক্তব্যেও দিচ্ছেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটিও নিশ্চয়ই কমে আসবে।
 
বাংলাদেশে ফেসবুকের আরেকটি বড় সমস্যা হলো, ভিন্নমতকে সহ্য করতে না পারার প্রবণতা। ফেসবুকে আমরা ভার্চুয়াল আড্ডাই দিই। পার্থক্য হলো, আগে আমি বেছে নিতাম আমার আড্ডায় কারা কারা থাকবে। সে সব আড্ডাতেও চায়ের কাপে ঝড় উঠত বৈকি। কিন্তু মোটের ওপর সমমনারাই আড্ডায় জমায়েত হতো। কিন্তু ভার্চুয়াল জগতে সেই সীমারেখা নেই। এখানে তাই পরস্পরবিরোধী মতবাদে বিশ্বাসী দুই পক্ষ মুখোমুখি হয়ে যায়। কখনো কখনো সেই আলোচনা যুক্তির বদলে কদর্য বাক্যবিনিময়ে রূপ নিয়ে নেয়। বিরুদ্ধমতকে শ্রদ্ধা করা ‘ভলতেয়ার'রা অবশ্য বরাবরই সংখ্যালঘু ছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটিও আশা করি বদলে যাবে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমগুলো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে নিশ্চয়ই। বিকল্প গণভোটের ভূমিকা পালন করবে এই মাধ্যম। সরকারকে, ক্ষমতাধরদের শুনতেই হবে সাধারণ মানুষের কথা। করতে হবে জবাবদিহি। 
 
মানুষের মুখ বন্ধ নেই। সেই মুখের গ্রন্থিত বই হয়ে উঠেছে ‘ফেসবুক'। যে ফেসবুক শুধু রাজনৈতিক ভাষ্যের মঞ্চ হয়ে নেই। বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ, পথশিশুদের পুনর্বাসন, শিক্ষা - কত কাজে জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীরা। 
 
সামাজিক উদ্যোগের দিক দিয়ে বাংলাদেশই সম্ভবত সবচেয়ে সফলভাবে সামাজিক মাধ্যমকে আক্ষরিক অর্থেই ‘সামাজিক' করতে পেরেছে। রক্তের সাহায্য চেয়ে দেয়া পোস্টগুলোতে এই অভিজ্ঞতা হয় আমার।
 
এমনও দেখেছি, গণজাগরণ মঞ্চের তুমুল বিতর্কের সেই সময়টায় মঞ্চের এক কর্মীর মায়ের সংকটাপন্ন অবস্থায় রক্ত দিয়ে গেছেন মঞ্চের বিপক্ষে সবসময়ই সোচ্চার একজন। এই ছবিটাই যেন সার্থক হয়। 
 
ভিন্নমত থাকবে, তর্ক থাকবে, ঝগড়া থাকবে; কিন্তু এটাই মনে রাখা দরকার যে, তুমি ডানপন্থি হও কিংবা বাম আদর্শে বিশ্বাসী; সে তুমি উদারপন্থি হও কিংবা কট্টর; তোমার ধর্ম, তোমার মতবাদ আমার থেকে আলাদা হলেও রক্তের রং কিন্তু ভাই একই!
 
সংবাদকর্মী রাজীব হাসানের ব্লগ থেকে 
 
বিবার্তা/হুমায়ুন/ফারিজ
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com