পাঁচটি স্তম্ভের ওপর ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। রোজা তার মধ্যে একটি। পবিত্র রমজান মাসের পুরো একটি মাস রোজা রাখা ধনী-দারিদ্র নির্বিশেষে সব মুসলমানের ওপর ‘ফরজ’ বা অবশ্য কর্তব্য করা হয়েছে।
আল্লহ পাকের উদ্দেশ্য করনীয় অন্যান্য ‘ফরজ’ সমূহের তুলনায় রোজার গুরত্ব সর্বাধিক। কারণ আর সব ফরজের মধ্যে বান্দার কিছু না কিছু ব্যক্তিগত স্বার্থ নিহিত থাকে, কিন্তু রোজা ‘খাছ’ আল্লহরই উদ্দেশ্য।
এ সম্পর্কে কুরআন পাকে বলা হয়েছে- ‘আদম সন্তানের নেক আমলের সওয়াব দশ থেকে সাত গুণ পর্যন্ত দেওয়া হবে; কিন্তু রোজার ব্যাপারে তেমন নয়। রোজা খাছ আমার জন্য। রোজাদার কেবল আমার খুশির জন্য কামনা, বাসনা ও পানাহার ত্যাগ করে রোজা রাখা। সেজন্য আমি নিজেই এর প্রতিদান দেবো।’
কয়েকটি বিশেষ কারণে এ মাসের এক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। যেমন-
১. এ মাসের ১০ তারিখে হজরত ইব্রাহীমের আ.-এর ওপর ‘ছহিফা’ শরিফ নাজিল হয়।
২. এ মাসের ১৩ তারিখে হজরত ইসার আ.-এর ওপর ‘ইঞ্জিল’ শরিফ নাজিল হয়।
৩. এ মাসের ১৮ তারিখে হজরত দাউদের (আ.) ওপর ‘যবুর’ শরিফ নাজিল হয়।
৪. সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব ‘আল-কুরআন নাযিল হয় হজরত মুহাম্মাদের সা.- এর ওপর এ মাসের ২৭ তারিখে। অতএব দেখা যায়, প্রায় সবগুলো আসমানি কিতাবই নাযিল হয়েছে এই পবিত্র রমজান মাসেই। তাই এ মাসের গুরুত্ব অত্যধিক। এ মাসের ‘নফল’ নামাজ অন্য মাসের ‘ফরজ’ নামাজের সমান। এ মাসের একটি ‘ফরজ’ নামাজ অন্য মাসের ৭০টি ‘ফরয’ নামাজের সমান।
রোজার আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এর উপকারিতা শুধুমাত্র একটি নয়- পারলৌকিক ও ইহলৌকিক দুটোই।
পারলৌকিক
১. রোজাদারের আল্পক্ষণের সাধনা অনেক বেশি সাওয়াবের। রোজাদারের শুধুমাত্র সৎকর্ম নয়, কুরআন পাকে বলা হয়েছে- ‘রোজাদারের নিদ্রা তার এবাদতের তুল্য।’ তা হলে দেখা যাচ্ছে, একজন রোজাদার সামান্যমাত্র আয়াসে মাত্র একটি মাসে যত বেশি ছাওয়াব লাভ করতে পারে, কঠোর সাধনা করে সারাটা বছর ধরেও তা পারে, অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের মুসলমানদের জন্য রমজান একটি পরম নিয়ামতের মাস।
২. রোজাদারের শুধুমাত্র কর্ম বা চিন্তা নয়, তার দেহের প্রতিটি অঙ্গই পবিত্রতা লাভ করে। তার গোটা দেহটাই যেন পরিণত হয় একটি পবিত্র সাধনার আলয়ে। তার দেহের প্রতিটি অনুই আল্লাহর কাছে পরম প্রিয়। এমন কি রোজাদারের মুখের গন্ধ পর্যন্ত আল্লহ পাকের কাছে কস্তুরীথেকেও সুগন্ধি ও মনোরম বলে হাদিসে-পাকে উল্লেখিত হয়েছে।
৩. রোজাদারের আরোএকটিবড় সৌভাগ্য এই যে, সে তার অতীতের কৃত সর্বপ্রকার গুণহ থেকে মুক্তি লাভ করে। রোজা অতীতের সব রকম কালিমাকে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে তাকে দান করে এক প্রবিত্রতম শান্তির ঐশ্বর্য্য।
৪.আল্লাহ পাকের লক্ষ কোটি অতুলনীয় এবং অসীম গুণাবলীর মধ্যে কোনও একটির পরিপূর্ণ অধিকার হওয়া কোনও মানুষের পক্ষে সম্ভাব নয়। কিন্তু একমাত্র রোজাদারই সেই পরম সৌভাগ্যটির নৈকট্য লাভ করতে সক্ষম হয়। আল্লহ পাকের পানাহারমুক্ত। রোজাদার একটি মাসে দিনের বেলাতে পানাহারমুক্ত থেকে স্রষ্টারনৈকট্যলাভকরেথাকে। সৃষ্টির এমনি ত্যাগ সাধনাতে স্রষ্টা বড়ই খুশি হন।
৫. বেহেস্তে প্রবেশের আটটি দরজা রয়েছে। এ গুলোর মধ্যে ‘রাইয়ান’ দরজাটি সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদাপূর্ণ। আর এই সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হতে পারবে শুধুমাত্র রোজাদাররাই। অর্থাৎ শুধুমাত্র রোজাদারদের জন্যই এই দরজাটি সংরক্ষিত রয়েছে। এরচেয়ে বড় সৌভাগ্য রোজাদারদের আর কি হতে পারে?
৬.রোজাদারের প্রতি ফেরেশতাগণও কৃপাবান থাকেন। এ সময় তাঁরা রোজাদারদের সর্বপাপ মুক্তির জন্য দু’হাত তুলে আলহ পাকের নিকট দোয়া চাইতে থাকেন এবং আলহ পাক ফেরেস্তাগনের সম্মান রক্ষা করেন। অর্থাৎ রোজার সাহায্যে রোজাদার শুধুমাত্র নিজের পথই আলোকিত করে না, তার চলার পথের সাহায্যকারী বন্ধুকেও খুজে পায়।
৭. কেয়ামতের দিন রোজাদারদের জন্য রোজা শাফায়েতকারীর কাজ করবে। রোজার পরম বন্ধু রোজাদার। তাই বন্ধুর মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাবে না।বন্ধুর শাফায়েতের জন্য অবিস্রান্তভাবে সে করুণাময়ের কাছে নিবেদন করতে থাকবে। রোজার অসংখ্য পারলৌকিক নিয়ামতের মধ্যে মাত্র কয়েকটির আলচনা করা হল। এবার আমরা দেখবো,এর কি কি ইহলৌকিক বা পার্থিব উপকার রয়েছে –
ইহলৌকিক
১. মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনে রোজা বিশেষভাবে সাহায্য করে। মিথ্যাকথন, গীবত, হিংসা, আত্মম্ভ্ররিতা বোধ ইত্যাদি অসৎ স্বভাবগুলো রোজাদারের বিশেষভাবে পরিত্যাজ্য। প্রকিত রোজাদার এসব বদ স্বভাব হতে দূরে থেকে মহৎ চরিত্র গঠন করে নিতে সমর্থ হয়।
২.রোজা দরিদ্র লোকদের প্রতি ধনীলোকদের সমবেদনাবধ জাগাতে সহায়তা করে। নানাবিধ প্রাচুর্যের মধ্যে বাস করেও ধনীরা দরিদ্রের ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভাব করতে পারেনা। কিন্তু শুধুমাত্র রোজার মাধ্যমেই ধনীরা তা অনুভাব করতে সক্ষম হয়। এমন করেই তাদেরও হৃদয়ে দরিদ্রের প্রতি একটা স্বাভাবিক সহানুভূতিবোধ জাগরিত হয়।
৩. রোজা মানুষকে ফাঁকি দেওয়ার অভ্যাস থেকে দূরে রাখে। রোজাদার ইচ্ছা করলে লোকচক্ষুর অন্তরালে যেয়ে অনেক কিছু পানাহার করতে পারে। কিন্তু সে তা করে না। কারন সে উপলব্ধি করতে পারে যে,অপরকে ফাঁকি দিতে ইচ্ছা করলে নিজেই ফাঁকির শিকার হতে হয়।
৪. রোজা মানুষকে ধৈর্য, সংযম ইত্যাদি মহৎ গুণাবলী শিক্ষা দেয়। অনেক সংযমতার সাথে সে রোজার নিয়ামবলি পালন করে এবং ইফতারীর মুহূর্ত পর্যন্ত আহার সামগ্রী সম্মুখে নিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু লোভের বশবর্তী হয়ে সময় হওয়ার পূর্বে তা ভক্ষণ করে না। এমনিকরে রোজা মানুষের লোভী স্বভাব দূর করে।
৬. রোজা মানুষের আয়ু বৃদ্ধি করে। কোন প্রানী যতদিন পর্যন্ত বাড়তে থাকে, ততদিন বার্ধক্য আসে না। বাড়া বন্ধ হয়ে গেলেই দেহের মধ্যস্থিতযন্ত্র সমূহের ক্ষয় শুরু হয় এবং মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হয়। তাই দেহের বৃদ্ধিসাধন ধীরে ধীরে হওয়াই মঙ্গলজনক। একমাসের রোজা বা উপবাস দেহের এই ধীরবর্ধনে সহায়তা করে। এই তথ্যটি চিকিৎসাশাস্ত্রে স্বীকৃত।
৭. রোজা বেশ কিছু যন্ত্রণাদায়ক রোগের নিয়ামক। এক মাসের রোজা মানুষের দেহের মধ্যকার দুর্বল হৃৎপিণ্ড, রক্ত চলাচল, যকৃৎ প্রভৃতিকে সবল ও সতেজ করে তোলে। একটা ফুসফুসের পুরানো দুরারোগ্য ‘কফ’ দূর করে। তাছাড়া বহুমূত্র রোগীদেরও পক্ষে রোজা বিশেষ উপকারী । বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন – যারা নিয়মিত ভাবে রোজা পালন করে, সাধারনতঃ তাঁরা বাত, বহুমূত্র , অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপ ব্যাধিতে আক্রান্ত হন না।
এছাড়া রোজার আরও বহুবিধ পার্থিব উপকারও রয়েছে। মাত্র কয়েকটির আলোচনা করা গেলো।
রোজা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য এক পরম নিয়ামত। আলহ পাক বলেছেন- ‘আনতাছুম খায়রুল লাকুম ইনকুনতুম লা’তামুন।’ অর্থাৎ রোজার যে কি উপকার তা যদি তোমরা জানতে! এর উভয়বিধ ফজীলত মুসলমানদের কাছে এক সীমাহীন শান্তি ও পুরস্কার স্বরূপ।
রোজার এই বিশেষ নিয়ামত আলহ পাক বলেছেন- ‘রোজাদারদের জন্য আমি দুইটা পুরষ্কার রেখেছি, একটা পৃথিবীতে এবং অপরটা মৃত্যুর পরে।’ কিন্তু এই রোজা বলতে আমরা কি বুঝি? সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উপবাস করলে কি রোজা পালন করা হল? না, তা হয় না। উপবাস ত সবাই করতে পারে। এর মধ্যে কোনও বাহাদুরী নেই।
তাই আমাদের প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য- যাতে আমরা প্রকৃত রোজাদারের গুণাবলী লাভ করে ধন্য হতে পারি, তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। যখনই আমাদের এ প্রচেষ্টা সার্থক হবে, শুধু তখনই আমরা আল্লাহ পাকের এই পবিত্র নিয়ামতের সৌভাগ্যবান অধিকারী হতে পারবো। তখনই ধন্য হবে আমাদের মানব জীবন। সার্থক হবে আমাদের সকলের ইহকালীন ও পরকালীন জীবন।
বিবার্তা/জিয়া