শারীরিকভাবে সমর্থ হলে রোজা রেখে রক্ত দিতে কোনো অসুবিধা নেই। এ ব্যাপারে সমকালীন ইসলামী চিন্তাবিদরা একমত পোষণ করেছেন। মুফতী ওসমান সাহিন বলেন, শারীরিক সমস্যা না থাকলে রক্তদানে ইসলামী শরীয়ায় কোনো বাধা নেই।
এ প্রসঙ্গে তিনটি হাদীস উদ্ধৃত করা যায়:
~ হযরত আকরামা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘নবী করিম (স.) হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধা অবস্থায় শরীর থেকে শিংগার* মাধ্যমে রক্ত বের করেছেন এবং রোজা অবস্থায়ও শরীর থেকে শিংগার মাধ্যমে রক্ত বের করেছেন।
হযরত সাবিত আল বানানী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘হযরত আনাস বিন মালেক (রা.) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছে যে রোজাদারের জন্য শরীর থেকে শিংগা লাগিয়ে রক্ত বের করাকে আপনি কি অপছন্দ করেন? জবাবে তিনি বলেন, না আমি অপছন্দ করি না। তবে দুর্বল হয়ে পড়ার ভয় থাকলে ভিন্ন কথা। [সহীহ আল বোখারী ১:২৬০]
~ একইভাবে শিংগা লাগানোও অপছন্দ নয়। অর্থাৎ দুর্বল হয়ে পড়ার ভয় না থাকলে রোজা অবস্থায়ও শিংগা লাগিয়ে রক্ত বের করা যায়। [শামী কিতাব ২:৩৯৯]
~ রোজা অবস্থায় তেল ও সুগন্ধী ব্যবহার করলে রোজা ভাঙে না। একইভাবে শিংগা লাগালেও রোজার ক্ষতি হয় না। [হেদায়া কিতাব ১:২১৭]
*শিংগা হলো গরু বা মহিষের শিং দিয়ে তৈরি বিশেষ এক রকম নল যা দিয়ে মানবদেহের দুষিত রক্ত, পুঁজ বের করা হতো দেহকে ব্যথামুক্ত করার জন্য। তাই আপনার রক্তদানের সময় হলে ইফতারের পর ল্যাবে এসে রক্ত দিন। অর্জন করুন কমপক্ষে ৭০ গুণ বেশি সওয়াবের বরকত।
একজন মুমূর্ষু মানুষকে রক্ত দিয়ে সহযোগিতা করার ফজিলত সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ও ইসলামী চেতনা প্রসারিত থাকলে পেশাদারদের রক্তের বিভীষিকা থেকে মুক্ত থাকতে পারত মানুষ। উল্লেখ্য, হাদিসে বর্ণিত আছেঃ
‘মৃত্যুপথযাত্রী একটি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর বিনিময়ে এক দেহ ব্যবসায়ী নারী জান্নাতের অধিকারী হয়েছে।’ এর দ্বারা খুব সহজেই অনুমান করা যায়, সৃষ্টির প্রতি আল্লাহতায়ালার প্রেম ও দরদের পরিমাণ।
এমতাবস্থায় আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে রক্ত দিয়ে বাঁচতে সাহায্য করা ইসলামের দৃষ্টিতে কত বড় একটি মহৎ কাজ তা আর বিশ্লেষণ করে বলার অবকাশ নেই। হাদিসের আলোকে বলা যায়, হতে পারে স্বেচ্ছায় রক্তদান আমার-আপনার জান্নাতে যাওয়ার উসিলা।
আর এটা যদি ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রসার করা যায়, তাহলে খুব সহজেই স্বেচ্ছায় রক্তদানের প্রবণতা প্রবলভাবে তৈরি হবে সবার মাঝে। যে প্রবণতাটা আজ সমাজের খুব বেশি দরকার। পৃথিবীতে অনেক মহৎ কাজ রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম মহৎ কাজ হলো স্বেচ্ছায় রক্তদান।
কারণ, রক্ত কোনো ফ্যাক্টরিতে উৎপাদন হয় না, কেবল একজন মানুষের প্রয়োজনে আরেকজন মানুষ তা দিতে পারে। রক্তদান পরোপকারের
একটি মাধ্যমও বটে।
আর মানুষের উপকার প্রসঙ্গে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন,
‘তোমাদের কেউ তার অপর ভাইয়ের উপকার করতে সক্ষম হলে সে যেন তা করে।’(মুসলিম শরিফ)
রক্তদান একটি মানবিক দায়বদ্ধতা ও সামাজিক অঙ্গীকার। কাজেই আমাদের কারও একজনের রক্তের বিনিময়ে যদি কোনো এক ভাই, অসুস্থতা থেকে সুস্থ হয় বা তার জীবন রক্ষা পায়, তাহলে আমাদের স্বেচ্ছায় রক্তদান করা উচিত এবং অন্যকেও রক্তদানে উৎসাহিত করা আমাদের কর্তব্য।
কোরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘একজন মানুষের জীবন রক্ষা করা সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করার মতো মহান কাজ।’(সূরা মায়েদা)
৩২ স্বেচ্ছায় রক্তদানে অন্য মানুষের মূল্যবান জীবন রক্ষা পায় এবং নিজের জীবনও ঝুঁকিমুক্ত থাকে। নিয়মিত রক্ত দিলে নিজের জীবনও ঝুঁকিমুক্ত রাখা সম্ভব হবে। সৎকাজ ও নেক নিয়তের জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে যথাযথ প্রতিদানও মিলবে। যেহেতু আমাদের দেশের প্রচুর মানুষ রক্তের অভাবে অসুস্থ জীবন কাটাচ্ছে বা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, তাই তাদের পাশে আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হবে।
যেহেতু ইসলাম বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়াতে বলে, মুমূর্ষু মানুষের জীবন রক্ষার কথা বলে আর জনসেবামূলক এই কাজে যেহেতু কোনো ধর্মীয় বিধিনিষেধও নেই, সেহেতু জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য সবাইকে একযোগে পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখবেন, একে অন্যের উপকার, সহানুভূতি ছাড়া মানবজীবন মূল্যহীন। পবিত্র কোরআনে কারিমের সূরা হুজরাতের ১০নং আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন……. মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই।’
কাজেই এক ভাই অন্য ভাইয়ের বিপদে-আপদে, বালা-মুসিবতে এগিয়ে আসবে এটাই ইমানের অপরিহার্য একটি অঙ্গ।
রোজা রাখা অবস্থায় কোন মুমূর্ষ রুগীর জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে রক্ত-দিন। যদি খুবই জরুরি না হয়, তাহলে ইফতারের পরে রক্ত-দান করাই উত্তম। তাই অন্তত রোযার ও ইসলামের দোহাই দিয়ে রক্তদান এড়িয়ে যাবেন না।
বিবার্তা/ডিডি/ইফতি