দেশের শিক্ষাব্যবস্থাপনার কারণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে গিয়ে এবারও শিক্ষার্থীরা হাবুডুবু খাবে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী জিপিএ-৫ পেয়েও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাবে না ১৫ হাজার শিক্ষার্থী; যা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের জন্য শুধু হতাশারই নয়, দুঃখজনকও। তবে বরাবরের মতো এবছরও বেড়েছে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ এর সংখ্যা।
বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যখন নতুন প্রজন্মকে শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত মানুষ হিসেবে তৈরির জন্য বিনামূল্যে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ দেয়া হচ্ছে, যেখানে বই-পুস্তকসহ সকল প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে; যেখানে নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে সবাইকে উৎসাহিত করা হচ্ছে; সেখানে আমাদের দেশে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এসে শিক্ষাজীবনের তিনটি ধাপ পেরিয়ে জ্ঞানের নতুন রাজ্যে প্রবেশের জন্য প্রতিযোগিতার শেষ নেই। প্রথম সারির উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় একটি আসন পেতে একজন শিক্ষার্থীকে অন্তত অর্ধশত শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভর্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়।
এরই মধ্যে এ বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসনসংকটের কারণে জিপিএ-৫ পেয়েও ১৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবে না। পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে ‘অদ্ভুত’ সব নিয়ম তৈরি করেছে পদ্ধতিগত জটিলতা। এসব কারণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে বিপাকে পড়তে হয় মেধাবী শিক্ষার্থীদের।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য বলেছেন, কোনো শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না। কিন্তু বাস্তবতা চরম ভিন্ন ধরনের; এখন দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ভিন্ন ভিন্ন শর্ত ও নিয়ম রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী নিয়মগুলো প্রণয়ন করে থাকে। এর ফলে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের প্রায়ই বিপাকে পড়তে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলো হলো প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ ও তারিখ নির্ধারণে সমন্বয়হীনতা, কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা গ্রহণ, প্রতিটি ভর্তি পরীক্ষার জন্য আলাদা ফি নির্ধারণ, একই ইউনিটে ভর্তিতে একাধিক শিফটে পরীক্ষা গ্রহণ এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন সংযোজন।
এছাড়া ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির জন্য আলাদা শর্ত রয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে আবেদন করতে হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার বিষয়ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। ফলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য এক ডজনেরও অধিক আবেদন করতে হতে পারে। আবেদন শেষে প্রবেশপত্র পেতে লেগে যায় দীর্ঘ সময়। ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য হাতে যথেষ্ট সময় না থাকায় প্রায়ই হয়রানির শিকার হন শিক্ষার্থীরা। এসব কারণে একদিকে শিক্ষার্থীদের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এবং অন্যদিকে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জীবনের শুরুতে তারা শিফট-শিফট পরীক্ষায় বৈষম্য দেখেছে। দেখেছে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে ভর্তি হতে পরীক্ষা দিচ্ছে সবাই। অথচ একেকজনকে একেক প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ চিত্র দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে একটি বিষয়ে ভর্তির জন্য ৬টি শিফটে পরীক্ষা হচ্ছে। একেকটি শিফটের জন্য একেক ধরনের প্রশ্ন প্রণয়ন করা হচ্ছে। এর কোনোটিতে সহজ প্রশ্ন আসছে আবার কোনোটিতে তুলনামূলক কঠিন প্রশ্ন আসছে। শিক্ষকদের একরোখা মনোভাবের ফলে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের এ পদ্ধতিগত জটিলতা থেকে বের হতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়টি।
যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, স্থানসংকটের কারণেই তাদের আলাদা শিফটে পরীক্ষা নিতে হচ্ছে। তবে বাস্তবতা হলো, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানসংকটের কারণে নিকটবর্তী প্রতিষ্ঠানগুলোয় ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে তাদের কিছু অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হয়। সেই অর্থ যাতে খরচ না হয় সে কারণেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পৃথক শিফটে পরীক্ষা গ্রহণ করে থাকে।
নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা শিক্ষার নামে ব্যবসা দেখেছে, দেখেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাও। যেই উদাসীনতার সুযোগে গড়ে উঠেছে ‘শিক্ষা বাণিজ্য’। এই বাণিজ্যের আরেকটি পন্থা হলো- ইউনিট বাড়িয়ে বাড়তি অর্থ আদায়।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা - এই তিনটি ধারায় পড়াশোনা করে থাকে। ফলে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে তিন বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য তিন ধরনের এবং সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে বিভাগ পরিবর্তনের জন্য একটি পরীক্ষা নেয়াকে আদর্শ ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ পদ্ধতি হিসেবে মনে করেন সংশ্লিষ্ট অনেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘদিন ধরে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও এ পদ্ধতি অনুসরণ করছে। তবে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কৌশল হিসেবে সুকৌশলে আলাদা পরীক্ষা গ্রহণ চালু করেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬টি ইউনিট এবং দুটি ইন্সটিটিউট রয়েছে। এর মধ্যে কলা ও মানবিক অনুষদভুক্ত ‘সি’ইউনিটে ৯টি বিষয় রয়েছে। এই নয়টি বিষয়ের প্রত্যেকটির জন্য আলাদা ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য একজন শিক্ষার্থীকে সর্বোচ্চ ১৬টি বিষয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হতে পারে। এসব ইউনিটে ভর্তির আবেদন করতে হলে শিক্ষার্থীদের দেড় শ’থেকে সাড়ে তিন শ’টাকা গুণতে হয়। ফলে একদিকে সময়ের অপচয় ও হয়রানি এবং অন্যদিকে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের স্বার্থেই পদ্ধতিগত এ জটিলতাগুলো জিইয়ে রেখেছে বলে দীর্ঘদিনের অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
একই অবস্থা বিরাজমান চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রতিটি ইউনিটের আবেদন খরচ পড়ে ৩০০-৫০০ টাকা। কিন্তু এভাবে বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা কেন চলবে? তার উত্তর কেউ জানে না। জানে না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বয়হীনতায় ভোগান্তিতে পড়া শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধান করতেও। আর এই অথর্বদের কারনেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। চরম দূর্ভোগে পড়ছে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা।
অনেক সময় একই সময় কিংবা কাছাকাছি সময়ে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পড়ে যায়। এর ফলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে শিক্ষার্থীদের দেশের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হয়। ছাত্ররা অভিভাবক ছাড়া পরীক্ষা দিতে গেলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে ছাত্রীরা তা পারে না। ফলে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে যেতে হয়। অনেক সময় সেটি সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও প্রায়ই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীকে প্রতিযোগিতার ট্রেন থেকে ছিটকে পড়তে হচ্ছে।
এছাড়া ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নে নিজস্ব পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নের মিল থাকে না। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েন। এমন একটি হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সকলের সচেষ্ট থাকা প্রয়োজন।
সবাই যদি নতুন প্রজন্মের রাজনীতি-শিক্ষা-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক গবেষক হিসেবে বাংলাদেশের পরীক্ষিত প্রতিনিধিদেরকে শিক্ষার সকল সমস্যা সমাধানে নিবেদিত থাকেন, তখন তারাও সকল সমস্যা না হোক কিছু সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে আশা করা যায়। এক্ষেত্রে অবশ্য তারা প্রথমেই যে কাজটি করতে পারেন তা হলো, সকলের সাথে সমন্বয় করে সিলেবাসের বাইরে থেকেও ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরির সিস্টেম পরিবর্তন। আর তা করতে পারলে এসব সমস্যার পাশাপাশি অন্যতম একটি সমস্যা- মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসে নেই এমন সব বিষয় ভর্তি পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার মতো একটি নিয়মবহির্ভূত সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পাবে শিক্ষার্থীরা। বন্ধ হবে পদ্ধতিগত জটিলতায় পড়ে থাকা কোচিং ব্যবসাও।
আমাদের দেশে একশ্রেণীর শিক্ষক যেভাবে কোচিং বাণিজ্য জমিয়ে তুলেছে, তাও বন্ধ হবে যদি নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সকল সমস্যা সমাধানে নতুন করে এগিয়ে আসে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহল। তা না হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রশাসন। কেননা, নেতৃত্বে যদি প্রকৃত মেধাবীরা না আসে, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের অর্থনীতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি ও প্রশাসন, যা আমাদের কারোই কাম্য না।
আর তাই চাই, ‘শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা নয়/জ্ঞান ছড়িয়ে আনবো জয়’এই শ্লোগানকে সামনে রেখে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে। যেখানে শিক্ষাই হবে ভবিষ্যৎ গড়ার হাতিয়ার; অস্ত্র বা দুর্নীতি নয়।
লেখক : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ (এনডিবি)
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন