রিভেঞ্জ পর্ণোগ্রাফি বা প্রতিহিংসামূলক যৌনছবি বর্তমানে একটি মহামারীর নাম। প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে ভাঙন ধরলেই এক শ্রেণীর রুচিহীন লোক নিজেদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিওগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে অনলাইনে। আর এসব দেখে আদিম পরিতৃপ্তির ঢেকুর তোলে অনেকেই।
চায়না মোবাইল শুধু তৃতীয় শ্রেণীর কিছু মুরাদ টাকলা ফেসবুকারই উপহার দেয়নি, বাই প্রোডাক্ট হিসেবে উপহার দিয়েছে এই রিভেঞ্জ পর্ণও। যতটুকু মনে পড়ে, আমাদের ছাত্রজীবনে ‘একটেল সুমন’ নামের এক পার্ভার্টের মাধ্যমেই এদেশে প্রথম অশুভ সূচনা হয় এই অসুস্থ ধারার্। এরপর একে একে নির্ঝর চৈতী, প্রভা, ইভা রহমান, আসিফ নজরুল, পরিমলসহ অনেক জলই গড়িয়েছে। আর এখন তা পরিণত হয়েছে এক দূরারোগ্য মহামারীতে।
বাংলাদেশে ‘সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন’ অনুযায়ী পর্ণ ছবি তৈরী বা বাজারজাতকরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও তার প্রয়োগ আছে সামান্যই। প্রকাশ্যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখের সামনেই রাস্তার ওপর বিক্রি হচ্ছে এসব উত্তেজক সামগ্রী। আর এসব দোকানে রীতিমতো ভিড় করে এগুলো কিনছে কিশোর-যুবকেরা। কারো কোনো বিকার নেই সেদিকে, দেখেও না দেখার ভান করে চলেছে সবাই।
ইন্টারনেটের সুবাদে এখন আর সিডি কেনার প্রয়োজনই হয় না। ১০/২০ টাকার এমবি কিনে এসবের পেছনে ওড়ানো হচ্ছে গৌরীসেনের টাকা। ক’দিন আগে আমার মোবাইলের ডিসপ্লে ঠিক করাতে গিয়ে নিউমার্কেটের একটি দোকানে কিছুক্ষণ বসেছিলাম। এর মধ্যেই দুটি কিশোর এসে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলো হিডেন ক্যামেরা বা রিয়েল রেপ সিন আছে কিনা। ‘আছে’ বলতেই ওরা পেনড্রাইভ ভরে সেসব নিয়ে গেলো মাত্র ৪০ টাকার বিনিময়ে।
সবচেয়ে অবাক হয়েছি এবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে। আমাদের শৈশবে যে গ্রামের ছেলেদের ফুটবল ও হাডুডু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে দেখেছি, এখন তাদেরও হাতে হাতে চায়না স্মার্টফোন আর দল বেঁধে ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে দেখে চলেছে এইসব ‘মজার’ জিনিস। তারা হয়তো ‘মজা’ পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু জানতেও পারছে না কতজনের বুকফাটা কান্না আর দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে সেই ‘মজার’ জিনিসগুলোতে।
কিছুদিন আগে স্বস্তিকার একটি আর্ট ফিল্মে দেখেছি, এই ভিডিওগুলোর কারণে কী ভয়াবহ পরিণতি নেমে এসেছিল এক অভিনেত্রীর জীবনে। সবাই প্রভার মতো অসীম সাহসে ঘুরে দাঁড়াতে পারে না, বেশিরভাগই হারিয়ে যান বিস্মৃতির অতলে। কারণ আমাদের পুরুষতান্ত্রিক নোংরা মানসিকতা নির্ঝরদের হিরো বানালেও তিন্নিদের বেশ্যা হিসেবেই ট্রিট করে থাকে।
ভারতে পর্ণোগ্রাফিক সাইট নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব ওঠার পরে সেই দাবিটি এখানেও উঠেছিল। তখনই এক শ্রেণীর ‘সুশীল’ সমাজ শুরু করে দিয়েছিলেন চিৎকার। কারণ তাদের মতে এতে নাকি মানুষের অধিকার (!) ক্ষুণ্ন হয়।
বুঝি না পর্ণোগ্রাফি কি অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতোই কোনো অত্যাবশ্যকীয় উপাদান যে তা নিষিদ্ধ করলে মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়ে যাবে?
আজ ওয়ালে ওয়ালে যারা ৮ মিনিট, ৮ মিনিট করে উল্লাস প্রকাশ করে চলেছেন, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, কী ভয়াবহ ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে মেয়েটির জন্য। ছেলেটি তো আপনাদের কাছে হিরোই হবে তার ‘পারফরমেন্সের’ জন্য। যেমনটা হয়েছিল নির্ঝর বা সুমনরা। এমনটা তো আপনার বোন বা ভাবীর ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে, নাকি?
বিবার্তা/মৌসুমী/হুমায়ুন