জলজট-যানজট নিরসনে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার

জলজট-যানজট নিরসনে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ১৩:৫৬:১৫
জলজট-যানজট নিরসনে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার
প্রিন্ট অ-অ+


গত মাসে অতিবৃষ্টির কারণে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা ছিল। এর ফলে যানজটও বৃদ্ধি পায়। জলাবদ্ধতা ছাড়াও রাজধানীর যানজট কয়েক বছর ধরে অতিমাত্রায় দৃশ্যমান ছিল। সাম্প্রতিককালে জলাবদ্ধতার কারণে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য অতীতেও অতিবৃষ্টির কারণে ঢাকার কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতা ছিল। এর মধ্যে শান্তিনগরসহ তেজগাঁও এয়ারপোর্টের রাস্তার একাংশে এ দৃশ্য দেখা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। এয়ারপোর্টের রাস্তার গুরুত্ব অনেক বেশি। এ ছাড়া এ রাস্তাকে ভিআইপি রাস্তা বলা হয়। আশির দশকে একজন সামরিক শাসক এ দৃশ্য দেখে তাৎক্ষণিক এ সমস্যা দূর করার নির্দেশ দেন। এর ফলে সংস্কারমূলক কিছু কাজ করার পর এ দৃশ্য আর দেখা যায়নি। এবার জলাবদ্ধতা ছিল সব কটি প্রধান সংযোগ সড়কে। ১৯৮৭-৮৮ ও ১৯৮৮-৮৯ সালের বন্যায় রাজধানীর অভিজাত এলাকা নামে পরিচিত গুলশানে নৌকা চলার দৃশ্যও আমাদের অনেকের কাছে অপরিচিত ছিল না। ওই সময় থেকে নগর পরিকল্পনাবিদসহ পানিবিশেষজ্ঞরা রাজধানীর ৩২টি খাল সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কিন্তু কোনো সরকারই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ব্যতিক্রম ছিল ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই সরকার হাতিরঝিল প্রকল্প সুপরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করার ফলে ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা যথেষ্ট আশান্বিত হয়েছিল। তবে বর্তমানে এ বিষয় নিয়েও কিছু প্রশ্ন উঠেছে। যে প্রকৌশলী হাতিরঝিলের উন্নয়নের জন্য নকশা প্রণয়ন করেছিলেন, তিনিও এ বিষয়ে বর্তমানে আশাহত। কারণ হাতিরঝিল সংলগ্ন খালের পার ওয়াসা ভরাট করেছে। রাজধানীর খালগুলো সচল করার বিষয়টি নিয়ে এবারও দুই মেয়রসহ বিশেষজ্ঞরা কথা বলেছেন। এর জন্য একটি দৈনিক যে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করেছে সে বৈঠকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও উত্থাপন করা হয়। জলাবদ্ধতাসহ যানজট নিরসনের জন্য সমন্বিত উদ্যোগসহ রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কথাও এ বৈঠকে বলা হয়েছে।



এ বিষয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকও গত বুধবার সংবাদ প্রকাশ করেছে। এ সংবাদে পাঁচটি বিষয় বুলেট আকারে বলা হয়েছে। এক. ঢাকা মহানগর প্রায়ই জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছে, কারণ খালগুলোর অবস্থা করুণ; দুই. খালগুলো অবৈধভাবে দখল ও ভরাট হওয়া নিরসনে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি; তিন. অপরিকল্পিতভাবে খালে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে; চার. সিটি করপোরেশনসহ ওয়াসা ভরাট হওয়া খালগুলোর সমস্যা মোকাবিলায় অক্ষম এবং পাঁচ. প্রভাবশালী ব্যক্তিরা খালের দুই পাশে, এমনকি মধ্যভাগে স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। এ সংবাদে আরো বলা হয়েছে, সিটি নির্বাচনের সময় দুই মেয়র পদপ্রার্থী নির্বাচনী অঙ্গীকার হিসেবে বলেছিলেন, তাঁরা নির্বাচিত হলে খালগুলো পুনঃখনন করবেন। বর্তমানে তাঁরা বলছেন, এ কাজ করার জন্য তাঁদের না আছে আইনি ক্ষমতা, না আছে প্রয়োজনীয় সম্পদ। এর ফলে মেয়ররা কিছু বাস্তব সমস্যার কথাও বলেছেন, যা অস্বীকার করার উপায় নেই। উত্তরের মেয়র বলেছেন, ওয়াসার মালিকানাধীন ৬০০ কিলোমিটার নর্দমা রয়েছে। লেকগুলোর মালিক জেলা প্রশাসন। সেখানে সিটি করপোরেশনের কিছু করার নেই। এ ছাড়া অনেক খাল কিছুদূর যাওয়ার পর বন্ধ হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ রূপনগর ও কল্যাণপুর খালের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ইংরেজি দৈনিকের সংবাদ অনুযায়ী মিরপুরের কিছু খালের বিষয়ে একই কথা বলা হয়েছে। ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতে, অতীতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নপুষ্ট এক প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করে ১৩টি খাল সংস্কার করা হয়েছে। জলজট-যানজট নিরসনে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রকল্পের সমাপ্তির পর কোনো অর্থ না পাওয়ার কারণে এ বছর এ বিষয়ে বাজেটে কোনো অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। অর্থাৎ পানি নিষ্কাশনের বিষয়টি নিত্তনৈমিত্তিক বিষয় হলেও এর জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর ওয়াসা নির্ভরশীল; অথচ রাজধানীর সব বসতবাড়ি থেকেই স্যুয়ারেজ বাবদ প্রতিমাসে কিছু অর্থ বিলে ধার্য করে আদায়ও করা হয়। স্যুয়ারেজের মধ্যে বর্জ্য নিষ্কাশনই নয়, বরং ব্যবহৃত পানিও রয়েছে। উত্তরের মেয়রের মতে, একাধিক সংস্থা জড়িত বিধায় সমন্বিত কার্যক্রমের বিষয়টি কঠিন। একমাত্র ওয়াসাই প্রকল্পনির্ভর নয়। বরং সরকারি অন্যান্য সংস্থাও রয়েছে। এ বিষয়ে গত বুধবার কালের কণ্ঠে প্রকাশিত কিছু বিষয় আলোকপাত করা হয়েছে। এ সংবাদের শিরোনাম ছিল 'ঢাকা বাঁচাতে শুধুই প্রকল্প'। এতে কয়েকটি প্রকল্পের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। যেমন নগরবাসীদের বন্যার প্রকোপ থেকে বাঁচানোর জন্য বেড়িবাঁধ প্রকল্প। স্লুইসগেট ও বৃত্তাকার নৌপথ। সবই এখন অকেজো। আবার অনেকে বলছেন, বেড়িবাঁধের ফলে জলাবদ্ধতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকল্প হঠাৎ করে ঘোষণার মাধ্যমে নেওয়া হয়। কিছু প্রকল্প রয়েছে যার সমাপ্তির পর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো অর্থ বা জনবল বরাদ্দ করা হয় না। ফলে এগুলো অচিরেই অকেজো হয়ে যায়। প্রকল্প বাস্তবায়নে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয় তা অল্পদিনের মধ্যেই নিষ্ফল হয়ে যায়।



সমন্বয়ের সমস্যা নিরসনের জন্য মেয়রের প্রস্তাব হলো, একটি নতুন সংস্থা সৃষ্টি করার প্রয়োজন রয়েছে। নগর উন্নয়নের জন্য সমন্বয়ের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। অতীতেও এ সমস্যার বিষয়ে বর্তমান মেয়রদের পূর্বসূরিরা বারবার উত্থাপন করেছেন। এ জন্য তাঁরা সিটি সরকার সৃষ্টির প্রস্তাব দিয়েছিলেন, যা কোনো সরকারই গ্রহণ করেনি। বিএনপি সরকারের এক আমলে এ সমস্যা নিরসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তবে তা ফলপ্রসূ হয়নি। এ কমিটি কয়টি সভা করেছে এবং এসব সভার গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ও জনগণের অজানা। তবে বলা যায় যে কমিটি অকার্যকর ছিল। এখন কমিটির পরিবর্তে বলা হচ্ছে নতুন সংস্থার কথা। নতুন সংস্থা হলেই যে সমস্যার সমাধান হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কথাও বলা হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এর অর্থ যদি হয় ক্ষমতাসীন সরকারকেই অঙ্গীকার করতে হবে তাহলেও অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় যে তা ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে, পরিবেশবাদীরা কয়েক বছর আগে 'বুড়িগঙ্গা বাঁচাও' আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। সংসদ ভবনের সামনে এর জন্য এক সম্মেলনও করা হয়। এ সম্মেলনে ওই সময়ে ক্ষমতাসীন সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের ব্যক্তিরাও প্রকাশ্যে অঙ্গীকার করেছিলেন যে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হবে। এর জন্য সরকার যা কিছু করা প্রয়োজন তা করবে। বলাবাহুল্য, সে অঙ্গীকার এখনো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণে বলা যায় যে একাধিক সংস্থা এ কাজটি করবে, তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দুর্বল ছিল। এখন ঢাকা বাঁচাও ডাকে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হলেই যে তা জনগণের জন্য সুফল বয়ে আনবে এমনটি ভাবা যায় না।



রাজনৈতিক অঙ্গীকারের সঙ্গে প্রশাসনিক ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা নিরসনও প্রয়োজন হবে। তা না হলে রাজনৈতিক অঙ্গীকারে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। খাল, বিল ও জলাভূমি সংরক্ষণের জন্য এক দশক আগেই আইন করা হয়েছে। এটাই হলো রাজনৈতিক অঙ্গীকার। অথচ এ আইন সত্ত্বেও খাল, বিল ও জলাভূমি দখল অব্যাহত রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো প্রশাসনিক দুর্বলতা। এ বিষয়ে মিডিয়া অনেক তথ্য বছরের পর বছর প্রকাশ করলেও এ ধরনের প্রবণতা রোধ করা যায়নি। যারা খালসহ জলাভূমি দখল করছে তাদের বেশির ভাগ প্রভাবশালী ব্যক্তি হলেও এদের মধ্যে কিছু পরিবার গৃহহীন। সামান্য আশ্রয়ের জন্যই কাঁচা বাসস্থান নির্মাণ করেছে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এ শ্রেণিভুক্ত ব্যক্তিদেরই উচ্ছেদ করা হয়। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রশাসনিক দুর্বলতার বিষয়টি ঢাকার আশপাশের নদীতীরবর্তী জমি বেদখল হওয়ার বিষয়ে উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান ছিল এবং এখনো আছে। সরকারি ও উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী জেলা প্রশাসন খুঁটি বসালেও তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এরপর সবাই চুপ। একমাত্র মিডিয়া ও পরিবেশবাদীরা ছাড়া। মিডিয়া ও পরিবেশবাদীরা নাগরিক সমাজেরই অংশ। তারা প্রতিবাদ করলেও কোনো ফল হয় না। নাগরিক সমাজের প্রতিবাদী হওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে সদ্য আগত জাতিসংঘের প্রতিনিধি হেইমার বেলেফেশওট শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাঁর এ বক্তব্য মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। নাগরিক সমাজের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্র সংকুচিত হলে সুশাসন ব্যাহত হয়। এ সত্যটি যদি কেউ উপলব্ধি না করতে পারে তাহলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। ৫ সেপ্টেম্বর গোলটেবিল বৈঠক হওয়ার পর শনিবার ১২ সেপ্টেম্বর বৈঠকের পূর্ণাঙ্গ বিবরণী প্রকাশ করা হয়েছে। জলজট-যানজটে বিপন্ন ঢাকা মহানগরীকে রক্ষা করার জন্য বৈঠকে উপস্থিত ব্যক্তিরা নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। আলোচনার মূল সুপারিশ ছিল মোট সাতটি- ১. খাল উদ্ধার করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই; ২. হাতিরঝিল প্রকল্পের সার্থক বাস্তবায়ন সমন্বিত উদ্যোগের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এ কৌশল অবলম্বন করা যায়; ৩. পয়োবর্জ্য শোধনাগারে পৌঁছানোর জন্য মহাপরিকল্পনা প্রয়োজন। পয়োবর্জ্য ও বৃষ্টির পানি কখনো এক নালা দিয়ে যেতে পারে না; ৪. ড্যাপ (DAP) কার্যকর করলে ভয়াবহ জলজট হবে না; ৫. ঢাকাকে বাঁচাতে হলে এক আন্তরিক রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন; ৬. জলাশয় আইনভঙ্গকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং ৭. জলাশয় ভরাটের অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে।



বলাবাহুল্য, ওপরে উল্লিখিত সুপারিশের মধ্যে ৬ ও ৭ নম্বরের সুপারিশ একই ধরনের। এ ছাড়া সুপারিশের মধ্যে রাজধানীর আশপাশের নদীগুলোর সংস্কারে কোনো মত প্রকাশ করা হয়নি। নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা হ্রাস পেলে অতিবৃষ্টির কারণে জলজট তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। এ ছাড়া কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কিছু প্রাতিষ্ঠানিক সুপারিশও করা হয়েছে। যেমন দুই মেয়রের নেতৃত্বে এক বা দুই কমিটি ও বিষয়ভিত্তিক টাস্কফোর্স গঠন।



লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

 


সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com