রেলের রেকর্ড ও আমাদের ‘ভয়’

রেলের রেকর্ড ও আমাদের ‘ভয়’
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০১৬, ১৭:৩৯:৫৬
রেলের রেকর্ড ও আমাদের ‘ভয়’
প্রিন্ট অ-অ+
তহবিলসংকটে পড়ে অনেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এগোতে পারে না, ধুঁকতে থাকে এবং ধুঁকতে-ধুঁকতে এক সময় বন্ধ হয়ে যায় – এ অতি পুরনো গল্প। কিন্তু দেশবাসীর তো এ গল্প শুনতে-শুনতে কান পচে গেছে। তাই বুঝি এবার ‘নতুন গল্পের’ আয়োজন! বাংলাদেশ রেলওয়ে সেই ‘নতুন গল্পের’ জন্মদাতা। অভিনন্দন বাংলাদেশ রেলওয়ে!
 
দিনকয় আগে রেলের সেই ‘বিরল কৃতিত্বের’ কাহিনী ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। বলা হয়েছে, ২০১১ সালে রেল মন্ত্রণালয় আলাদা হয়েছে। তার পর থেকে রেলে সরকারের অর্থ বরাদ্দ ক্রমেই বেড়েছে, আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোকসান। গত অর্থবছরে রেলের লোকসান বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। রেলের ইতিহাসে এটাই নাকি সর্বোচ্চ লোকসান। অর্থাৎ লোকসানের নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তাকে অভিনন্দন না-জানিয়ে কি পারা যায় ? 
 
এই রেকর্ড গড়ার জন্য কত ‘কষ্টই’ না করতে হয়েছে রেলকর্মকর্তাদের! অনির্ধারিত স্টেশনে ট্রেন থামা বন্ধ করা এবং রেললাইনের দু’পাশে গড়ে ওঠা অবৈধ মার্কেট ও বস্তি উচ্ছেদ করা হলে ট্রেনের গতি বাড়বে, যাত্রী বাড়বে এবং আয়ও বাড়বে। তাতে রেলের লোকসান কমতো বটে, কিন্তু সর্বোচ্চ লোকসানের রেকর্ড গড়া কি সম্ভব হতো? কে না বলবে, টাকার চেয়ে রেকর্ড বড়!
 
এই রেকর্ড গড়ার জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাকে পর্যন্ত ‘প্রক্রিয়ার জালে’ ফেলে অকার্যকর করে রাখার ‘সাহস’ দেখিয়েছে রেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈদ্যুতিক রেলপথ প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কারণ, বৈদ্যুতিক রেলপথে জ্বালানির দরকার হয় না। ট্রেন চালাতে লাগে বিদ্যুৎ। ট্রেনে ডিজেল ইঞ্জিনেরও দরকার হয় না। রেলপথের ওপর স্থাপিত লাইন থেকে সঞ্চালিত বিদ্যুৎ দিয়েই চলে ইঞ্জিন। এসব ইঞ্জিনের দামও অনেক কম, দুই কোটি টাকা। অথচ বর্তমানে ব্যবহৃত ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের দাম গড়ে ২৫ কোটি টাকা। ডিজেল ইঞ্জিনের বড় ধরনের মেরামত বা ওভারহোলিংয়ে ৬০ লাখ টাকা খরচ হয়, বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনের একই ধরনের মেরামতে খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা।  বৈদ্যুতিক রেলপথ চালু হলে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট, ২০  বার যাওয়া-আসা করতে বিদ্যুৎ লাগবে ১০ মেগাওয়াট। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এক ট্রিপে লাগবে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
 
এখন এক কিলোমিটার ট্রেন চালাতে জ্বালানি খরচ হয় ১,১০০ টাকা। ইলেকট্রিক ব্যবস্থায় এই খরচ হবে মাত্র ২৪ টাকা।
 
ডিজেলচালিত মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও পাওয়ার কার মেরামতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে রেলে। আর প্রতিবছর ডিজেল চুরি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার।
 
শুধু কি তা-ই, পণ্য পরিবহণ বাড়ালে রেলের আয় বাড়তো। কেননা, এক টন পন্য পরিবহণে এক কিলোমিটারে খরচ ২২ পয়সা, আর আয় এক টাকা ৫২ পয়সা। কিন্তু এ পথেও হাঁটছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেকর্ড করা বলে কথা, তা সে রেকর্ড যতই নেতিবাচক হোক। 
 
আরো একটি বিষয়ে রেলের তৎপরতার ‘প্রশংসা’ করতেই হয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) রেলকে যে ঋণ দিয়েছে, তার অন্যতম শর্ত হলো  লোকসান কমাতে প্রতিবছর রেলের ভাড়া বাড়াতে হবে। ঋণদাতার এ শর্ত পালনেও রেল সদাসক্রিয়। এতে লোকসান কিছুটা কমলেও রেকর্ড গড়া বিঘ্নিত হবে না বলে রেলের নিন্দা করার কিছু নেই। 
 
সব মিলিয়ে বলতে হয়, দেশ ও্ জাতিকে নতুন রেকর্ড  উপহার দিতে গিয়ে নিজের লোকসানকেও আমলে নিচ্ছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। কবিগুরুর সামান্য ক্ষতি কবিতার মহিষী করুণা যেমন বুঝতে পারেননি মাঘ মাসের শীতল বাতাসে জমে যাওয়া তার শরীর উষ্ণ করার জন্য ক’টি কুড়েঘর পুড়িয়ে দিলে কী এমন ক্ষতি, আমরাও রেলের সামান্য ক’টা টাকা লোকসানে আক্ষেপের পক্ষপাতি নই। লোকসান হয়েছে বটে, রেকর্ডও তো হয়েছে! সেটা দেখতে হবে না?
 
তবে আমাদের ছোট একটি ‘ভয়’ আছে। ভয়টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রেলমন্ত্রী মুজিবুল হককে নিয়ে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছিলেন বৈদ্যুতিক রেলপথ প্রকল্প বাস্তবায়নের। রেলের রেকর্ডপ্রেমী কর্মকর্তারা ‘প্রক্রিয়ার জালে’ আটকে সেই নির্দেশনাকে অকার্যকর করে রেখেছেন। এখন সেই খবর সংবাদমাধ্যমে এসে গেছে। যদি প্রধানমন্ত্রী তাঁর সেই নির্দেশনার বর্তমান অবস্থা জেনে যান, যদি তিনি আবার এ ব্যাপারে সক্রিয় হওয়ার আদেশ দেন, কী হবে তখন?
 
রেলমন্ত্রী মুজিবল হককে নিয়েও ‘ভয়’ কম নয়। ষাটোর্ধ্ব বয়সের এই ‘তরুণ’ মানুষটি দায়িত্ব নেয়ার পর রেলে অনেক পরিববর্তন আসছে। নতুন নতুন ট্রেন চালু হচ্ছে, বিদেশ থেকে বগি আসছে, রেলপথ সংস্কার হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারছেন না, এতে রেলের আয় বাড়লেও লোকসান কমবে। লোকসানই যদি কমে, তাহলে আমাদের রেকর্ডের কী হবে!
 
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com