হায়রে আমার দেহের বিশেষ একজোড়া প্রত্যঙ্গ নিয়ে ঘানা বংশোদ্ভূত শান্ত দর্শন নার্সের সে কী হাতাহাতি! এদিক করে- ওদিক করে। আমি খালি গা। একবার সে ঠাণ্ডা যন্ত্রে প্রায় লটকে লটকে থাকে। একপর্যায়ে মনে হলো শরীর ও যন্ত্রের মধ্যে একটা সমঝোতা আনার কুস্তি এটা! যে করেই হোক তার পরিপূর্ণ ছবি চাই।
কিন্তু এ তো হাত কিংবা পা না যে ইচ্ছামতো দেহ থেকে বাইরে টেনে এক্সে মেশিনের গায়ে স্থাপন করা যাবে বা টা টা বাই বাই করা হাত বা নৃত্যপরায়ণ পা হিসেবে ছবি তোলা যাবে। এর নাম স্তন। ঠিক কলিজার ওপর গেড়ে বসা। যৌবনে সৌন্দর্য সুষমা ও ব্রীড়ার কারণ ছিল। সন্তান জন্মের পর তার অন্যজল হলো। এখন মেদ-মাংসে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। এখন পারলে মিনিমাইজার কিনি। এখন এ এক বিড়ম্বনা। শুরু থেকেই তা বুকে বসা লেডি বার্ডস হলেও যখন তখন কর্কট কামড়ে হতে পারে আমার অকস্মাৎ মরণ। আর এ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এই আব্রু খোলা- এই অজানা অচেনা নারীর কাছে আমার এই দেহখানি তুলে ধরেছি। পাগলের বিষ নেই, রোগীর কোনো পর্দা নেই। আর মৃতের নেই কোনো মতামত। ভ্রাম্যমাণ এরকম হাসপাতাল এখন সারা লন্ডন ঘুরে ঘুরে স্তন ক্যান্সারের জন্য মেমোগ্রাম করে।
মেশিন কি আর মন বোঝে? কাজেই ঠেসে ধরলেও সে কিছু বলে না। তার ভিতরে জোনাক জ্বেলে ছবি তুলে দেখা যাবে বুকের ভিতর কোনো গিট্টু আছে কিনা। কিন্তু জোরে আকর্ষণ করলেই কি, তা তো আর দেহের দরজা খুলে দূরে যেতে পারে না। বরং স্তনের সঙ্গে পুরো বুক বাহু এমনকি দেহও সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দেয়। কী জ্বালা! ও আমার কৃষ্ণবরণ কইন্যা বন্ধুয়ারে আমার এই দুই খণ্ড মেদ নিয়া কর তোমার মনে যাহা লয়। আর ভাইরে তারপর আমাকে মুক্তি দাও। জনপ্রিয় কবি ফেরদৌস নাহার কানাডা থেকে লন্ডনে এসেছেন। আমাকে এই ঝামেলা সেরেই তাকে ফোন করতে হবে। অথবা দেখব মোবাইলে কোনো ম্যাসেজ রাখল কিনা। আজাদের অসুস্থতায় ধমাধম বাড়ি বদলের সময় কত কিছু হারিয়ে ফেলেছি। কি আছে জীবনে। মানুষের চেয়ে বড় মাদক আর নেই। তাই সেই মানুষকে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি পাচারেই ছিল মন। প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার সাফল্যের সঙ্গে হারিয়েছি। দ্বিতীয়বারের চিঠি পেয়ে পাগলের মতো এসেছি। আমার এ পরীক্ষা করাতেই হবে। আমার প্যাট্রিসিয়া ও দীপাকে হারিয়েছি, আরও কিছু প্রিয় নারী ওই দুষ্ট, শয়তান, বদমাশ, গুণ্ডা ব্যাধি নিয়ে লড়াই করে চলেছে হাসিমুখে। তারা এমন সব কাজ নিয়মিত করে যাচ্ছে যে, সে সবার তো নমস্য হয়েছেই- আমারও তাদের দুবেলা সালাম করতে ইচ্ছে হয়।
ভালো অসুখ বলে কোনো কথা নেই। তবু এই স্তন কর্কটের ভালো দিক এই যে- প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লে বেঁচে যাওয়া যায়। একজন ছাড়া আমার পরিচিতা কেউই প্রথম অবস্থায় ধরা খায়নি। এমনকি আমার মতো নিয়মিত পরীক্ষাও করায়নি। আমিও কী করতাম? ওভাবে ভয় না পেলে আমিও পুতুর পুতুর করে দৌড় দিতাম না। লজ্জা লুকিয়ে এমন একটা ভালনার্যাবল অবস্থায় নার্সের সঙ্গে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় গল্প করে করে নিজের বেকুব চেহারায় চালাক ভাব আনার চেষ্টা করতাম না। কিন্তু সে কৃষ্ণা মমতাময়ী অনেক কৌশল জানে। কীভাবে শীতল ও শক্ত সেই ক্রেন মার্কা যন্ত্রে স্ক্যান করার জন্য কীভাবে হেলে পড়তে হয়, হাত তুলে সারেন্ডার ভঙ্গিতে দাঁড়াতে হয় সব সব। মেটালের ওপর আমার মেদখণ্ড বসিয়ে আমাকে স্থির হয়ে থাকতে বলে সে পালা করে আমার ওই অঙ্গ দুটোকে রঞ্জনরশ্মির জন্য একটা একটা করে ফিট করে ছবি নিতে থাকল। আমি শুধু নিম্নাঙ্গের পোশাক পরা অবস্থায় গা থেকে জোড়া মাংসপিণ্ড খুলে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম। তার কথায় কথায় একবার হাত পিছাই তো আরেকবার ঘাড়। এক সময় সে ধাতব অন্ধকার ফুঁড়ে কালো নারীর অহি নাজেল হয়, ওয়েল ডান মিসেস আজাদ, ইউ মে ড্রেস আপ নাউ। জামা গায়ে বাইরে এসে দেখি তাজ্জব কাণ্ড! স্ট্রবেরি আইসক্রিম রঙা পাপড়িতে ঢেকে গেছে আমার বাহন রুপালি রাজহাঁস। চাবি ঘোরাতেই রেডিও এফএমএ জনি ক্যাশ বাজতে থাকে যেন গয়না। আহা আহা! আর এদিকে এত পাপড়ি পড়েছে রাস্তায় যে নিজেকে রানী লাগছে। আজ আমি ফুলের ওপর দিয়ে রাজহাঁসে ভাসব। আকাশের আব গায়ে মাখব। আমার মুক্তি আলোয় আলোয়। তার আগে ফেরদৌস! ওকে পেলেই শুরু হবে আমাদের সেই মাতাল ভ্রমণ! কোথায় কবি, তুমি কোথায়? কিন্তু টেলিফোন ধরল রিন রিনে কণ্ঠস্বরের অন্য এক কন্যা। আমি এত আনন্দিত যে বলি, কি নাম তোমার কন্যা- কোথায় তোমার ঘর। এত সুন্দর স্বর। মেয়েটি হেসে কুটি কুটি।
-আপা আমি রেশমী।
-তুমি যে কি মিষ্টি।
-আপনি তো আমাকে দেখেনই নাই। আর আপনি যা অহঙ্কারী।
-অ্যা?
-আর আ আ আমি ফেইস বুকে আপনাকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম, আপনি অ্যাকসেপ্ট করেননি (সেই রিন রিনে হাসি) এত সহজিয়া নারী! তোমার হাসি যা সুন্দর। আমি অনেক কথা বলি তার সঙ্গে। গাড়ি স্টার্ট দিই না। বলি কেন আমি ফেইস বুকে ইন বক্সে কথা না বললে বন্ধু বানাই না। বলি সদ্য পরিচয় হওয়া সুলেখক সেগুফতা শারমিন তানিয়া এর কথা। বলি দেখ ঠিক চলে আসব একদিন।
-আপা, আসতে হবে না। শুধু আমার জন্য একটু দোয়া করবেন, আমি ব্রেস্ট ক্যান্সারের পেসেন্ট। ট্রিটমেন্ট স্টপ করা হয়ে গেছে। আর আশা নেই। আমার একটি ছয় বছরের ছেলে আছে আপা। ওর বাবা?... সে অনেক কথা আপা। দ্যাখা হলে বলব। বলে একটা শ্বাস ফেলে। কিন্তু এক মুহূর্ত মাত্র। আবার চনমন করে ওঠে। এবার আমার ফেইস বুকের ছবি দেখবেন। আমি খুব ফুলের ছবি তুলি। আর ফেরদৌস আপা আমাকেই দেখতে এসেছে। তানিয়া আপাও ফোন করেছে, দেখতে এসেছে। আপনি কবে আসবেন? কবে! এর পর গাড়ি স্টার্ট দিই। চলতে থাকি, পাপড়ি উড়তে থাকে, কিন্তু জনি ক্যাশ নেই। সে মারা গেছে। এই এখন। আমার কাছে নেই কিছু নেই। আমি আমার বুকের দিকে তাকাই। বালির ঢিবির মতো চুপ হয়ে আছে তারা। আমি কি তাদের চিনি! আমার পুত্র সজীব এখন এক পরিপূর্ণ যুবক। আমি তাকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে বড় হতে দেখেছি। আমার সজীবের ছয় বছর বয়সের কোমল মুখটা মনে পড়ল। নীল শার্ট পরে আছে। ধানমন্ডির বাসায়। স্কুল থেকে ফিরে চৌদ্দবার অকারণে মা মা করছে। সামনের দুটো দাঁত মাত্র পড়েছে। আহারে ওই বয়সের একটি বালকের মা চলে যাচ্ছে চিরতরে। হঠাৎ আমি একদম নিঃস্ব হয়ে গেলাম। জারেজার হয়ে কাঁদতে থাকলাম। স্পষ্ট পৃথিবী অস্পষ্ট হয়ে এলো। ঈশ্বর, মা জাতির এত প্রয়োজনীয় অঙ্গে তুমি কী করে এত বিষ দাও- কেন দাও! (১৪ মে-২০১৩ সালের নোট। রেশমীর অকাল প্রয়াণ হয়েছে তার কমাস পর। এখন আমার আরও দুজন কাছের মানুষ কী ভীষণ যুদ্ধ করে চলেছে! এখন প্রতি পাঁচজনে একজন নারীর স্তন ক্যান্সার হচ্ছে। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লেই কেবল আমরা বাঁচবো। বাঁচবে আমাদের সন্তানও।)
লেখক : কবি