যানজট নিরসনে পুলিশের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হোক

যানজট নিরসনে পুলিশের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হোক
প্রকাশ : ১৯ ডিসেম্বর ২০১৫, ০৯:৫১:৪৫
যানজট নিরসনে পুলিশের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হোক
প্রিন্ট অ-অ+
ঢাকার যানজট অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে অনেক আগেই। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের হাজার হাজার কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে যানজটে। ঢাকায় কখন থেকে যানজট শুরু হয়েছিল সে হিসাব হয়তো ঠিক করে বলা যাবে না। তবে যানজট যে এখন একটা প্রকট সমস্যা এটা বড় করে বলা যায়।রাজধানীতে যারা চলাচল করেন। প্রতিনিয়ত প্রয়োজনের তাগিদে যাদের ঘর থেকে বের হতে হয় তারা বোঝেন যানজটের কী জালা? এই যানজট নিরসনে গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতিটি সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু তাদের সে পদক্ষেপ কোনো কাজে এসেছে বলে মনে হয় না। কারণ যানজট দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ থেকে মুক্তির উপায় কী? এই প্রশ্নের জবাব অনেকের কাছেই নেই। তবে সম্প্রতি পুলিশ যানজট নিরসনের লক্ষ্যে একটি গবেষণা চালিয়েছে। ওই গবেষণায় বেশ কিছু কারণ উঠে এসেছে। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।  
 
প্রতিবেদনে যানজটের জন্য ১৯ টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণগুলো হলো,  অপ্রশস্ত রাস্তা, যত্রতত্র রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তায় যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে হাট-বাজার, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ, দোকানপাট বসানো, রাস্তায় নির্মাণসামগ্রী রাখা, আবাসিক ও বাণিজ্যিক বহুতল ভবনে কার পার্কিং না থাকা, পার্কিং থাকলেও বন্ধ রাখা, রাস্তায় যত্রতত্র বাস, মিনিবাস ও অটোরিকশা থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করা যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ সরকারি অন্য সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয়হীনতাকেও দায়ী করা হয়েছে।
 
পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা মহানগরী একটি অপরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে। নগর উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকার জমির মালিকদের ভূমি ব্যবহারে অদূরদর্শিতাকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকা শহরের ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মধ্যে ৮ শতাংশ ভূমি রাস্তা হিসেবে চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি আদর্শ নগরীর জন্য মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ ভূমি রাস্তার জন্য প্রয়োজন হলেও ঢাকা মহানগরীর মাত্র ৮ শতাংশ ভূমি রাস্তা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
 
সেই ৮ শতাংশ রাস্তার মধ্যে মাত্র ২.৫ শতাংশ কার্যকর সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৩ লাখ ২৫ হাজার যান্ত্রিক যান এবং ৭ লাখ রিকশা চলাচল করে। এসব রিকশার মধ্যে ৬ লাখ ২০ হাজারই অবৈধ। চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা ব্যবহৃত রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। উপরন্তু প্রতিদিন ১০০টি নতুন যান্ত্রিক যান রাস্তায় নামছে। ঢাকা মহানগরীর রাস্তায় ঠেলাগাড়ি থেকে রেলগাড়ি পর্যন্ত প্রায় ৩০ প্রকার যান চলাচল করে থাকে। রাস্তায় দ্রুতগতি ও ধীরগতিসম্পন্ন যানবাহন এবং একই সঙ্গে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করার ফলে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।
 
চলাচলের রাস্তায় অবৈধ পার্কিং, হকার কর্তৃক অবৈধভাবে ফুটপাত দখল করায় পথচারী ফুটপাত ব্যবহার করতে না পেরে রাস্তায় নেমে আসায় এবং রাস্তার পাশে পাইকারি কাঁচাবাজার থাকায় যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়। স্বয়ংক্রিয় পর্যায় ক্রমিক ট্রাফিক সিগন্যাল ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা, লেন মেনে যানবাহন চলাচল না করা, ট্রাফিক আইন না মেনে চলার প্রবণতা, ট্রাফিক আইন ও রীতিনীতি সম্পর্কে অজ্ঞতা। গাড়িচালকদের শিক্ষা সচেতনতার অভাব, যানবাহন ব্যবহারে অদক্ষতা, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তিতে জটিলতা এবং লাইসেন্সবিহীন বা নকল ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালানো।
 
ওই প্রতিবেদনের সঙ্গে যানজট নিরসনের জন্য পুলিশ কতগুলো সুপারিশও করেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের দেয়া ওই সুপারিশে তিনটি ধাপ রাখা হয়েছে। পুলিশ বলছে তাদের ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারলে ঢাকার যানজট অনেকাংশে কমে আসবে।তিনটি ধাপ হলো স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি। 
 
স্বল্পমেয়াদি সুপারিশে বলা হয়েছে, অবৈধ যানবাহন আটক এবং নতুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন সীমিত করে পুরনো গাড়ি নিষিদ্ধ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থা নেওয়া। রাস্তার পাশ থেকে হাট-বাজার ও ফুটপাত থেকে হকারদের সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সময়সূচি অফিস সময়সূচির সঙ্গে সমন্বয় করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমিয়ে আনার ব্যবস্থা নেওয়া। 
 
রাস্তার পাশে থাকা সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোর নিজস্ব জেনারেটরসহ ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেওয়া। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে সিএনজি স্টেশন অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া। আন্তঃজেলা বাস ও ট্রাক টার্মিনালগুলো নগরীর বাইরে স্থানান্তর করা, ট্রাফিক পুলিশ বিভাগকে আধুনিকায়ন করে ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম ও ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করে আধুনিক কন্ট্রোল রুম স্থাপনের মাধ্যমে অটোমেটেড ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা, ঢাকা শহরের সব লেভেল ক্রসিং এবং রাস্তায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস নির্মাণ করা।
 
মধ্যমেয়াদি সুপারিশ: গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোয় ফ্লাইওভার নির্মাণ করা, নগরীতে মেট্রোরেল, মনোরেল, ওভারহেড এক্সপ্রেসওয়ে ও ফুটপাত উন্নয়নে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা, পরিকল্পিত বাস রুট পরিচালনা করে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে প্রাইভেটকার ও মিনিবাস বন্ধ করে অধিকসংখ্যক যাত্রী বহনের উপযোগী বাস চালু করা অর্থাৎ ব্যক্তিগত গাড়ি নিরুৎসাহিত করা। অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ক্লিনিক, হাসপাতাল, গার্মেন্ট, শিল্প-কারখানা উপযুক্ত স্থানে স্থানান্তর করা, ঢাকা মহানগরীতে সারা দেশ থেকে আসা মানুষের চাপ কমাতে সব পর্যায়ে সব বিভাগ ও দফতরের ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করা এবং ঢাকা মহানগরীর ডিটেইল এরিয়া প্লান বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
 
দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ : আধুনিক নগরায়নের জন্য বিশিষ্ট নগর উন্নয়নবিদদের নিয়ে একটি গবেষণা ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা; ঢাকা মহানগরীতে সেবা প্রদানকারী বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, পয়ঃনিষ্কাশন, নগরায়ন ইত্যাদি সংস্থাগুলোর মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনকে গুরুত্ব দেওয়া; ঢাকা মহানগরীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা; দেশের সব নাগরিককে সচেতন করতে সংবাদমাধ্যম, লিফলেট, পেপারিং এবং বিভিন্ন এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে সারা দেশে ট্রাফিক ব্যবস্থার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা। 
 
আমরা মনে করি পুলিশের পক্ষ থেকে যে গবেষণা প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে এটি বাস্তবসম্মত। একই সঙ্গে এই গবেষণার সঙ্গে যানজট নিরসনে তারা যে সুপারিশ করেছে সেটাও যুক্তিযুক্ত। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারলে ঢাকার যানজট অনেকটাই কমে আসবে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশের এই সুপারিশ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয়া হোক। 
 
 
 
 
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com