সংযম ও আত্নশুদ্ধির বার্তা নিয়ে প্রতি বছর মুসলমানদের জীবনে আসে পবিত্র রমজান মাস। এসেছে এবারও। যথারীতি বিশ্বাসী মানুষরা রোজা রাখছেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে পড়ার চেষ্টা করছেন এবং সূর্যাস্তের সঙ্গে-সঙ্গেই বিপুল বিলাসী ইফতারসামগ্রী নিয়ে ইফতার করছেন।
এসবে আপত্তির কিছু নেই।কিন্তু যে আত্নশুদ্ধি ও সংযম পবিত্র রমজানের প্রাণপাখি, তা কি আছে আমাদের চিন্তায়, চেতনায়, কর্মে ও রোজা পালনে ? বরং সংযমের এই মাসটি এলেই আমরা যেন আরো অসংযমী ও বুভুক্ষু হয়ে পড়ি। আমাদের প্রতিদিনকার কয়েকটি কাজই সেই অসংযমের জ্বলন্ত সাক্ষ্য বহন করে।
প্রথমেই আসি ইফতারের কথায়। দিনভর রোজা পালন করে মানুষ ইফতারের সময় দু’টো ভালো-মন্দ খাবে তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু সেই খাওয়া কতটা , তার একটা সীমারেখা তো আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) নির্ধারণ করে দিয়ে গেছেন। আমরা কি সেই সীমা প্রতি রমজানে অহরহ লঙ্ঘন করছি না ! আমাদের এই অসংযমী বিলাস কি ইসলামসম্মত - প্রশ্নটি রসনাবিলাসী মানুষকে ভেবে দেখতে অনুরোধ জানাই।
আমাদের চারপাশে অসংখ্য গরীব মানুষ , সারা বছর যাদের মুখে ওঠে না তেমন ভালো কোনো খাবার, আমাদের বিলাসী ইফতারের আয়োজন একটু কাটছাঁট করে আমরা কি ওদের মুখে এই ক’টা দিন ভালো কিছু তুলে দিতে পারি না ?
এই ক্ষেত্রে আমাদের ধর্মীয় নেতাদেরও ভূমিকা থাকতে পারে। তারা মসজিদে ইফতারপূর্ব বয়ানে এবং জুমআ’র নামাজের আগে এই সংযমের শিক্ষাটা বার বার বলতে পারেন।
শুধু ইফতার নয়, পবিত্র রমজান এলেই আমরা যেন চতুর্গুণ উৎসাহে অসংযমী হয়ে পড়ি ব্যবসার মতো পবিত্র কাজেও। বিনা কারণে সব রকম জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিই বহুগুণ। সৃষ্টি করি কৃত্রিম সংকট। একশ্রেণীর ব্যবসায়ী পবিত্র এই মাসকে তাদের লোভের হাতিযার বানিয়ে ফেলে। তারা ভুলে যায়, স্বয়ং মহানবী (সা.) সৎ ব্যবসাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং বলেছেন, সৎ ব্যবসায়ীর স্থান হবে প্রথমে বেহেশতে; সিদ্দিকগণের সঙ্গে। তাঁর এ -কথার পরও মুনাফাবাজরা কি সংযমী হবে না !
অসংযমী হচ্ছি আমরা ধর্মের নামেও। প্রতিদিনই ভিন্নধর্মের মানুষ খুন হচ্ছে। খুনের পরই ‘দায়িত্ব স্বীকার’ করছে ‘ইসলামিক’ স্টেট নামের এক জঙ্গি গোষ্ঠী। আমরা ভাবতে পারি না, এ কোন ইসলাম। ক্ষমা ও মহত্ত্ব যাঁর চরিত্রের ভূষণ, সেই মহানবী (সা.) কি এই ইসলাম প্রবর্তন করেছিলেন ? এই চোরাগোপ্তা হত্যাকাণ্ড- কি তাঁর শিক্ষা ? সম্মুখসমর ছাড়া ভিন্নধর্মীকে তিনি বা তাঁর সাহাবীরা কি কখনো আক্রমণ বা হত্যা করেছিলেন ? কখনো কি বলেছিলেন যে, অমুসলমানদের সঙ্গে ন্যূনতম সৌজন্যের সম্পর্কও রাখা যাবে না এবং বিনা কারণেই তাদের হত্যা করতে হবে।
এমন অসংযমের শিক্ষা মহানবী (সা.) কখনোই দেননি। অথচ তাঁর উম্মত হয়েও আমরা কীভাবে যেন যাবতীয় অসংযম আত্নস্থ করে ফেলেছি এবং ব্যক্তিগত, সামাজিক, পেশাগত ও রাজনৈতিক - জীবনের সর্বক্ষেত্রে লাগামহীন অসংযমের চর্চা করে চলেছি। তাই প্রশ্ন জাগে, সংযমের মাস রমজান এসেছে, আমাদের সংযম কোথায়। কিসে সংযমী হতে পেরেছি আমরা ?
ইফতার, ব্যবসা, চিন্তা- চেতনা - সবকিছুতেই অসংযমী থেকে গিয়ে এই রোজা পালন, এ তো নিছক উপবাস - এ নিরেট সত্যটি আমরা কবে উপলব্ধি করবো ?