রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন : যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর। সোজা কথায়, যত অপরাধ ঘটে, সব দায় দুর্বলের। সবলের কোনো অপরাধ নেই। কর্তাবাবু বায়ুত্যাগ করলেও তাতে দুর্গন্ধ পেতে নেই।
তা-যে নেই সেটা আজ আমরা, মানে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো, হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি।
কথাগুলো বলতে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত সর্বসাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে। এ ঘটনায় দেশটির ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের অরল্যান্ডোতে পুরুষ সমকামীদের এক নাইট ক্লাবে হামলা চালায় এক বন্দুকধারী। হামলায় সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০ ব্যক্তি নিহত এবং প্রায় সমসংখ্যক আহত হয়েছে। বলা হচ্ছে, এটা আধুনিক আমেরিকার ইতিহাসে সবচাইতে রক্তক্ষয়ী গোলাগুলীর ঘটনা।
গোলাগুলি খুনখারাবি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, তা সে সমকামীদের নাইট ক্লাবে হোক কিংবা কোনো শিক্ষায়তনে। কিন্তু তারপরও তা বিশ্বের দেশে দেশে ঘটেই চলেছে। উন্নত ও গণতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন ঘটনা ঘটার খবর অল্প কিছু দিন পরপরই মিডিয়ার কল্যাণে আমরা জানতে পারি।
যেটা জানতে পারি না এবং করতে পারি না, সেটা হলো প্রতিক্রিয়া প্রকাশ। আমাদের দেশে কিছু-একটা হলেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, জাতিসংঘের মহাসচিব প্রমুখ তাবড় তাবড় মহাজন ব্যক্তিরা শোকে অচৈতন্যি হন, শোক প্রকাশ করে মুখে ফেনা তোলেন, প্রতিনিধি পাঠান, উপদেশ-নসিহত করে আমাদের ভাসিয়ে দেন।
এসব খুবই ভালো। কত্তারা আমাদের নিয়ে ভাবেন, ভেবেও ‘কেত্তাত্ত’ হই (কত্তায় কইছে ...দির ভাই,আহ্লাদের আর সীমা নাই)।
কিন্তু কত্তারা, ডরে-ভয়ে নদীর হেই পাড়ে গিয়া একটা কথা জানতে চাই : এখন কী বলবেন ? আমরা কি এবার বলতে পারি যে, আমেরিকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ, প্রবাসী বাংলাদেশীরা যেন সাবধানে চলাচল করে ! উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারি কি যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাব্যবস্থা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে!
না, পারি না। কারণ আমরা ‘গিন্নী’ নই, আমরা হলাম ‘কেষ্ট ব্যাটা’। অতএব, সব দোষ আমাদের।
পাঠক, আমাদের ভুল বুঝবেন না। আমাদের দেশেও অনেক হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং ঘটে চলেছে। মসজিদের মুয়াজ্জিন, মন্দিরের পুরোহিত, গির্জার পাদরি, ভিন্নধর্মী দোকানদার, কলেজছাত্রী তনু, গৃহবধূ মিতু – এরকম অনেক আলোচিত-অনালোচিত হত্যাকাণ্ড প্রতিদিন আমাদের দেশেও ঘটে চলেছে, যা বিবেকবান মানুষমাত্রকেই আহত-বিক্ষত করে। আমরা ক্ষুব্ধ হই, রক্তাক্ত হই। কিন্তু সাধারণ মানুষের কান্না আর কে শোনে !
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে ঘটনাটি ঘটলো, তাও নিঃসন্দেহে নিন্দাযোগ্য। আমরাও তার নিন্দা জানাই। শুধু প্রশ্ন জাগে, আমরা তো কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করি না, তাহলে আমাদের বেলায় কেন? আমাদের দেশে কোনো অঘটন ঘটলেই যে ‘বিশ্ববিবেক’ অস্থির হয়ে ওঠে, মার্কিনদেশের বেলায় তা কোন কুম্ভকর্ণের নিদ্রায় অজ্ঞান, জানতে বড় ইচ্ছা হয়।
কেউ কি আছেন, জানাবার ?