বরেণ্য লেখক হুমায়ূন আহমেদ তার এক বইতে মার্কিন পুলিশের বিষয়ে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তারা যাচ্ছিলেন নিউইয়র্ক থেকে বহুদূরের এক গন্তব্যে। যেতে যেতে তাদের গাড়ির চালক (অবশ্যই বাঙালি) গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেন। আমেরিকার হাইওয়েতে গাড়ির গতি ইচ্ছেমতো বাড়ানো বা কমানো যায় না। এই চালক আইনভঙ্গ করলেন।
অল্প সময়ের মধ্যে বিষয়টি জেনে গেল পুলিশ এবং ‘আসামী’ গাড়িটি থামালো। আমাদের দেশে হলে পরিস্থিতি কি হতো, পাঠক একবার কল্পনা করে নিতে পারেন। উপস্থিত পুলিশ সদস্যের হুমকিধামকি, চোটপাট, গাড়ি ও আরোহিদের থানায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা এবং অনেক অভদ্র আচরণ ও ভোগান্তি সহ্য করার পর মোট অঙ্কের নগদ নারায়ণের বিনিময়ে মুক্তি লাভ ঘটতো।
আর আমেরিকায়, হুমায়ূন আহমেদের চোখের সামনে ঘটলো সম্পূর্ণ অন্য রকম ঘটনা। পুলিশ এলো। হাসিমুখে গন্তব্য জানতে চাইলো। গন্তব্য জেনে আপনজনের মতো জিজ্ঞেস করলো, এবারই প্রথম যাচ্ছে কী না। লেখক নিশ্চিন্ত হলেন, আইনভঙ্গের জরিমানা থেকে বুঝি বাঁচা গেল। আমেরিকার পুলিশ প্রসন্ন মুখে কথা বললেন, কিন্তু আইন ভাঙলেন না। চালকের হাতে মোটা অঙ্কের জরিমানার টিকেট ধরিয়ে হ্যান্ডশেক করে বিদায় নিলেন।
হাসিমুখে স্বাভাবিক কণ্ঠে কথা, হ্যান্ডশেক এবং আইন রক্ষা - এরকম পুলিশ আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করি না। নানা বিরূপ অভিজ্ঞতায় ক্লান্ত আমরা বুঝি এখন আর এরকম পুলিশ চাইতেও ভুলে গেছি। কিন্তু কতটুকু চাই, সেটা না হয় বললাম না, কিন্তু কতটা চাই না, তা তো বলতে পারি। ভিক্ষে নাই বা পেলাম, কুত্তার কামড় থেকে তো রেহাই পেতে চাইব!
কথাগুলো আসছে পুলিশের চলমান ‘সাঁড়াশি অভিযান’ প্রসঙ্গে। অভিযানটি শুরুর আগের দিন ৯ জুন পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে একে ‘জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান’ বলে বর্ণনা করা হয়। পরদিন আরেক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে একে ‘জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযান’ বলে জানানো হয়।
নিয়ম অনুযায়ী সর্বশেষ প্রেস বিজ্ঞপ্তিটিকে সঠিক ধরে নিয়ে আমরা বলতে পারি, পুলিশ জঙ্গি ধরার জন্যই অভিযানটি চালাচ্ছে। তা অভিযানে কত জঙ্গি ধরা পড়লো? পুলিশ সদর দফতরের দেয়া হিসেব অনুযায়ী শুক্রবার পর্যন্ত আটক ও গ্রেফতার হওয়া ‘জঙ্গি’র সংখ্যা ১৯৪ জন। আর সারা দেশে মোট গ্রেফতারের সংখ্যা ১৩ হাজারেরও বেশি বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ঈদকে সামনে রেখে এই ধরপাকড় ‘সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি এনেছে’ বলেও দাবি করেছেন তিনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যে আমরা শতভাগ দ্বিমত করবো না। নিশ্চয়ই কোথাও-কোথাও চিহ্নিত সন্ত্রাসী আটক হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় স্বস্তিও নেমেছে। কিন্তু এটা কী সারা দেশের বেলায় সত্য?
আমরা মানতে রাজি নই। পুলিশের জঙ্গিবিরোধী লেবেলযুক্ত এ অভিযানে কথিত জঙ্গি ধরা পড়লো মাত্র শ’দুয়েক। আর বাকিরা? তারা কারা। তারা সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী, মাদকব্যবসায়ী অথবা বিভিন্ন মামলার আসামী। প্রশ্ন হচ্ছে ‘জঙ্গিবিরোধী বিশেষ অভিযানে’ এদের পাকড়াও করার মাজেজা কী?
এ প্রশ্নের জবাব আজ ভুক্তভোগী মানুষের মুখে মুখে। এবং তাদের মুখ থেকে এ কথা ছড়িয়ে পড়েছে মিডিয়ায়ও। একটাই কথা : গ্রেফতারবাণিজ্য।
আশার কথা হলো, পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের এই অভিযোগের কথা প্রধানমন্ত্রীরও গোচরীভূত হয়েছে। তিনি বলে দিয়েছেন, নিরপরাধ একজন মানুষও যেন গ্রেফতার বা হয়রানির শিকার না হয়।
প্রধানমন্ত্রীর এই সদিচ্ছাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু দুর্ভাবনা হলো, প্রধানমন্ত্রী তো আর থানায় থানায় গিয়ে দেখতে পারবেন না কে অপরাধী আর কে গ্রেফতারবাণিজ্যের শিকার। এটা তার কাজও নয়।
কিন্তু সবচাইতে বড় কথা হলো, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। ‘একজন নিরপরাধ মানুষকেও গ্রেফতার না করার’ জন্য তার দেয়া নির্দেশ অমান্য করার স্পর্ধা দেখাচ্ছে এক শ্রেণীর পুলিশ। ভুক্তভোগী মানুষের কণ্ঠে এসব অভিযোগ এবং হয়রানির অপমানমাখা কান্না পবিত্র এই রমজান মাসে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। এর মূল্য একদিন হয়তো আমাদের সবাইকে শোধ করতে হবে।
জঙ্গিবিরোধী বা সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান - কোনোটারই বিপক্ষে নই আমরা। আমরা এবং দেশের প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষ চায় দেশ থেকে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের ঘৃণ্য তৎপরতার অবসান হোক। কিন্তু সেই অপচ্ছায়া অবসানের নামে যদি চলে গ্রেফতারবাণিজ্য, তাহলে মানুষ কোথায় যাবে, কার কাছে কে যাবে?
আমাদের একটাই দাবি, শান্তিও চাই, নিরাপত্তাও চাই। ভিক্ষা চাই, তার আগে কুত্তা সামলান।