কী কুক্ষণেই পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক সমরেশ বসু (সমরেশ মজুমদার নয়) রচনা করেছিলেন ‘ছুটির ফাঁদে’ নামে এক উপন্যাস। তাতেও ক্ষতি কিছু ছিল না। গাঁটের পয়সা খরচ করে সেই বই এদেশে আর ক’জনই বা কিনতো, পড়তো! কিন্তু গোল বাধলো তখন, যখন এদেশের এক চিত্রপরিচালক বইটি অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের ঘোষণা দিলেন। রাতারাতি ‘ছুটির ফাঁদে’ নামটি পরিচিত পেয়ে গেল। সেই পরিচিতি একেবারে স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসলো একশ্রেণীর সাংবাদিকের কলমে। ঈদে-চাঁদের ছুটির সঙ্গে বাড়তি দু’একদিন সাপ্তাহিক ছুটি যোগ হলেই তারা একেবারে রে রে করে তেড়ে আসেন আর ক্রমাগত লিখতে থাকেন, ‘ছুটির ফাঁদ, ছুটির ফাঁদ।’
এবার সেই ফাঁদে অগ্নিসংযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। আসন্ন ঈদের ছুটির সঙ্গে শবে কদর ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে ছুটি হচ্ছিল আট দিন। এর মাঝখানে একটা মাত্র দিন থাকতো খোলা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর নির্বাহী ক্ষমতাবলে সেই দিনটিতেও ছুটি ঘোষণা করেছেন।
অতীতেও ঈদে-চাঁদে এমন ঘটনা ঘটেছে যে, বেশ ক’দিন ছুটির ঠিক মাঝখানে একটা মাত্র কর্মদিবস। সবা্ই জানে, সেই দিনটি কর্মদিবস হলেও অফিস-আদালতে উপস্থিতি থাকে নামেমাত্র। যারা থাকেন তারাও ঈদের কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে কোনোমতে অর্ধদিবস অতিক্রান্ত হতেই গৃহমুখী। হরেদরে এই কর্মদিবসের ফলাফল যা হয় তাকে এককথায় ‘অশ্বডিম্ব’ বলাই যথোচিত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই নামসর্বস্ব কর্মদিবসে অফিস ‘খোলা’ রাখার প্রহসনটি বন্ধের কোনো উদ্যোগই অতীতে কোনো সরকারকে নিতে দেখা যায়নি। ফলে প্রহসনের সেই ট্র্যাডিশনটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপন নির্বাহী ক্ষমতাবলে এবার সেই দুষ্ট ট্র্যাডিশনের মূলে কুঠারাঘাত করলেন। তাঁকে টুপিখোলা অভিবাদন।
আমরা মনে করি, ছুটি কখনো, কোনোভাবেই ফাঁদ হতে পারে না; বরং ছুটি কর্মোদ্দীপনা বৃদ্ধির অব্যর্থ টনিক। এই ঈদের ছুটিতে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব নগরবাসী মানুষ ছুটবেন গাঁয়ের পানে। সেখানে ফেলে আসা স্বজন-বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, কথা হবে। নগরের জটিল কুটিল জটাজালে আবদ্ধ মানুষের জীবনে এর চাইতে বড় আর কী হতে পারে !
মানুষকে এই পাওয়াটা পাইয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে আবারো সাধুবাদ জানাই এবং বিনয়ের সঙ্গে বলে, ছুটির বিষয়ে তিনি যদি আরো একটু ভাবেন, তাহলে মানুষের কল্যাণ বৈ অকল্যাণ হবে না। যেমন, দুই ঈদের তিন দিন ছুটি চালু করেছিল ব্রিটিশ শাসকরা। তারা এদেশের মানুষের সামাজিকতা, ধর্ম, প্রয়োজন কিছুরই তোয়াক্কা করতো না। তাই তারা দেশের প্রধান দু’টি উৎসবে নামকাওয়াস্তে তিনি দিন ছুটি দিযেই দায় সারতো।
আজ স্বাধীন দেশে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ রয়েছে। ভাবতে হবে, বিশাল জনসংখ্যার এই দেশে তিন দিনের ছুটি পেয়ে টেকনাফ বা তেঁতুলিয়ার ঢাকাবাসী মানুষটি গ্রামে যেতে অথবা গেলেও যথাসময়ে ফিরতে পারবেন কি? দুই ঈদের ছুটি তিন দিন কি বাস্তবসম্মত, যেখানে এ দু’টোই আমাদের অন্যতম প্রধান জাতীয় উৎসব।
আমাদের ভাবতে হবে, ঈদে গ্রামযাত্রী শুধু বয়স্ক মানুষ নন, তাদের সঙ্গে থাকে শিশু-কিশোররাও। এসব শিশুকিশোর শহরের খাঁচায় বন্দী হয়ে থাকে সারা বছর। ঈদের ছুটি তাদের এনে দেয় গ্রামে ছুটে যাওয়ার সুযোগ। কর্মজীবী বাবা-মা’র অফিস খোলার তাড়া থাকলে ছোটদেরও চলে আসতে হয় তাদের সঙ্গে। আবার দেখা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দিনটি হয় উৎসবের পরপরই। এটাও অযৌক্তিক। ঈদে বাড়ি যাওয়ার মতো ফেরার টিকিটও দুষ্প্রাপ্য। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি শুরুর তারিখটা একটু এগিয়ে আনা এবং খোলার তারিখটা একটু পিছিয়ে নির্ধারণ করা যায় কি না, সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।
সব মিলিয়ে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা ছুটির দিনগুলোকে বর্তমান প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলিয়ে সময়োপযোগী করা। আগামী ৪ জুলাই দিনটিকে ছুটির দিন ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী সেই পথে একটি সাহসী পদক্ষেপ নিলেন। আশা করা যায়, আমরা তার ধারাবাহিকতায় নতুন আরো যুগোপযোগী ও জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ দেখতে পাবো।