তুরস্কের সঙ্গে এ উপমহাদেশের আত্মিক সম্পর্ক বহু পুরনো। সেই সুদূর ব্রিটিশ শাসনামলে তুরস্কে খেলাফত বাতিলের বিরুদ্ধে অবিভক্ত ভারতবর্ষে গণআন্দোলন হয়েছিল। ইতিহাসের পাতায় সেটা ‘খেলাফত আন্দোলন’ নামে খ্যাত হয়ে আছে।
তারপর ইতিহাসের কত ঘটনা-দুর্ঘটনা, কত শাসকগোষ্ঠীর উত্থান-পতন এবং পৃথিবীতে কত পরিবর্তন! এসব ঘটনাপ্রবাহের ঢেউয়ে ভেসে গেল কত মিত্রশক্তি কত অক্ষশক্তি! কত রাজা এলো, কত রাজা গেল। রইলো শুধু জনতা।
রাজা যায়, রাজা আসে, থাকে শুধু জনতা - এটাই ইতিহাসের অমোঘ সত্য। কিন্তু ইতিহাসের একটা নির্মম শিক্ষা হলো, আমরা কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই না, জনতার ক্ষমতার কথা ভুলে যাই এবং ভুলে গিয়ে জনতার পছন্দ ও রায়কে গায়ের জোরে উল্টে দেয়ার চেষ্টা করি। যেমন, সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতে করা হলো তুরস্কে।
তুরস্কে এদিন সেনাবাহিনীর একটি অংশ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বসে। ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান নিয়ে রাজপথে নেমে আসে তারা। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন দখল করে ঘোষণা দেয় ‘গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক শৃঙ্খলা রক্ষা এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার’ লক্ষ্যেই অভ্যুত্থান করা হয়েছে। নতুন কথা কিছু নয়। দেশে-দেশে অবৈধ পন্হায় ক্ষমতা দখলকারীরা চিরকালই এমন বুলি আওড়ে এসেছে।
তারপরের ঘটনা সবার জানা। রাজধানী থেকে ছয় শ’ কিলোমিটার দূরে অবকাশযাপনরত প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে জনগণকে আহ্বান জানালেন রাস্তায় নেমে আসার। নিরস্ত্র জনগণ তাদের নির্বাচিত নেতৃত্বের ডাকে সাড়া দিল। তারা জাতীয় পতাকা হাতে ভয়ালদর্শন ট্যাংকের সামনে বুক পেতে দিল। জাগরিত জনতার উত্থানে শংকিত অভ্যুত্থানকারীরা পরাভূত ও পলায়মান হলো। জয় হলো জনতার।
এ অভ্যুত্থানচেষ্টা পণ্ড হওয়ার মধ্য দিয়ে তুরস্কে গণতন্ত্রের পক্ষে জাতীয় ঐক্যের যে প্রতিফলন দেখা গেছে, বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তের বিবেকবান ও গণতন্ত্রকামী মানুষ তাতে উজ্জীবিত বোধ করতে পারেন। জানা গেছে, অভ্যুত্থান ঠেকাতে সরকারী দলের নেতা কর্মী সমর্থক ও সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজপথে নেমে আসে প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিক পিপলস পার্টিসহ (সিএইচপি) ও দ্বিতীয় প্রধান বিরোধী দল ন্যাশনাল মুভমেন্ট পার্টিসহ (এমএইচপি) সব দলের নেতাকর্মীরা। সব দলই ওই রাতে বিবৃতি দিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা এবং এরদোয়ান সরকারের প্রতি সমর্থন জানায়।
সরকারবিরোধীদের এ অবস্থান কেন? তারা তাও পরিষ্কার করেছে। বলেছে, আমরা পরিবর্তন চাই, তবে তা কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নয়, নিয়মতান্ত্রিক পন্হায় ও গণতান্ত্রিকভাবে।
গণতন্ত্রের প্রতি দলমত নির্বিশেষে তুরস্কবাসীর এই অবিচল আস্থা নিঃসন্দেহে অভিবাদনযোগ্য। হ্যাট অফ টু টার্কি!
তুরস্কে এরদোয়ান সরকারের অনেক নীতিকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য মনে করে না বিরোধী দলগুলো। তাই তারা সরকারের পরিবর্তন চায়। কিন্তু তারা বিশ্বাস করে, এ পরিবর্তন আসতে হবে জনগণের ভেতর থেকে, জনগণের হাত দিয়ে। এটাই গণতন্ত্র। বন্দুকের নল ঠেকিয়ে যে পরিবর্তন তাতে দেশের মালিক জনগণের কোনো অংশগ্রহণ থাকে না। তাই সেরকম পরিবর্তন কখনই এবং কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ধাবমান ট্যাংকের সামনে বুক পেতে দিয়ে তুরস্কবাসী আবারো সেই সত্যই প্রমাণ করলো। অভিনন্দন তুরস্কবাসী! জয় হোক জনতার, জয় হোক গণতন্ত্রের!