বই-খাতা বিহীন প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে : মোস্তাফা জব্বার

বই-খাতা বিহীন প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে : মোস্তাফা জব্বার
প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০১৫, ১৩:১৫:৫৪
বই-খাতা বিহীন প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে : মোস্তাফা জব্বার
উজ্জল-এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+
মোস্তাফা জব্বার একটি নাম। বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তির ইতিহাসে একজন সফল ব্যক্তিত্ব। বিশিষ্ট কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ। কম্পিউটারে বাংলা লেখার সফটওয়ার ও বিজয় সফটয়্যারের নির্মাতা। লিখেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের কম্পিউটার শেখার বই। ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার পথিকৃৎ এই প্রযুক্তিবিদ ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ করে আসছেন।  গত রোববার রাজধানীর মতিঝিলের সার্কুলার রোডে আনন্দ কম্পিউটারস অফিসে  বিবার্তা২৪.নেটের  এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার আসার কথা, কম্পিউটারে বাংলা লেখার সফটওয়্যারের উদ্ভাবন,  এর পেছনের কথা, ডিজিটাল বাংলাদেশের বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির হালচালসহ সম-সাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বিবার্তা২৪.নেটের নিজস্ব প্রতিবেদক- উজ্জ্বল এ গমেজ।
 
বিবার্তা২৪.নেট:  বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার আসার গল্পটি বলুন।
 
মোস্তাফা জব্বার:  অনেক দূরের ঘটনা বলেও এই কথাটি অন্তত মনে আছে যে বাংলাদেশে স্থাপিত প্রথম কম্পিউটারটি বাংলাদেশে স্থাপনের জন্য কেনা হয়নি। সেটি পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশন লাহোরে বসার কথা ছিল। সেই মোতাবেক আইবিএম মেইন ফ্রেম ১৬২০ কম্পিউটারটি করাচি সমুদ্রবন্দরে পাঠানোর কথা ভেবেছিল। কিন্তু লাহোরে সেই কম্পিউটারটি পরিচালনা করার কোনো মানুষ পাওয়া যায়নি। কম্পিউটারটি চালনা করার দায়িত্ব পড়েছিল হানিফউদ্দিন মিয়ার ওপর। বাংলাদেশের গৌরব, নাটোরের এই কৃতী সন্তান পরমাণু বিজ্ঞানী হানিফউদ্দিন মিয়া ১৯২৯ সালের ১ নভেম্বর নাটোরের সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলশিক্ষক পিতা রজব আলী তালুকদারের দুই পুত্র ও এক কন্যাসন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ তিনি। সংসারে অভাব না থাকলেও উচ্চশিক্ষার জন্য জায়গির থাকতে হয় তাকে।১৯৪৬ সালে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৮ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএসসিতেও প্রথম বিভাগ লাভ করেন। এরপর ১৯৫২ সালে ঢাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এমএসসি পরীক্ষায় ফলিত গণিতে প্রথম শ্রেণীতে স্বর্ণপদকসহ প্রথম স্থান অর্জন করেন। এরপর ১৯৬০ সালে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন থিওরি অ্যান্ড অটোমেশন, চেকোস্লোভাক একাডেমি অব সায়েন্স, প্রাগ থেকে অ্যানালগ কম্পিউটার টেকনিক এবং ডিজিটাল কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে সিস্টেম অ্যানালিসিস, নিউমেরাল ম্যাথমেটিকস, অ্যাডভান্স কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, অপারেশন রিসার্চে এমআইটি [যুক্তরাষ্ট্র] কম্পিউটার সেন্টার থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে আইবিএম রিসার্চ সেন্টার লন্ডন থেকে অপারেটিং সিস্টেম ও সিস্টেম প্রোগ্রামিংয়ে ট্রেনিং করেন। তারপর তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থায়  প্রোগ্রামার অ্যানালিস্ট হিসেবে অ্যানালাইসিস, ডিজাইন, সফটওয়্যার ইমপ্লিমেশন অব কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রাম সংক্রান্ত বিষয়ে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে তিনি অঙ্কশাস্ত্র ও কম্পিউটার বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী ফরিদা বেগম ও এক পুত্র এবং দুই কন্যাসন্তানের জনক দেশের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার মোঃ হানিফউদ্দিন উদ্দিন মিয়া।  তাঁকে যখন লাহোর যেতে বলা হয় তখন তিনি বেঁকে বসেন। মূলত তার চাপেই করাচি সমুদ্রবন্দরে না গিয়ে কম্পিউটারটি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে আসে এবং পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশনের ঢাকা কেন্দ্রে সেটি স্থাপিত হয়। বৃহদাকৃতির ওই কম্পিউটারটি স্থাপন করতে দুটি বড় রুম ব্যবহার করতে হয়েছিল।
 
বিবার্তা২৪.নেট: ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৭ সময়টা ছিল বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির প্রথম অধ্যায় বা প্রাথমিক যুগ। সে সময়ের তথ্যপ্রযুক্তির অবস্থার বিষয়ে কিছু বলুন।
বই-খাতা বিহীন প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে : মোস্তাফা জব্বার
মোস্তাফা জব্বার:  বলতে গেলে বাংলাদেশে কম্পিউটার আসার পর থেকে শুরু করে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত যে সময়টি ছিলো তাতে কম্পিউটার প্রযুক্তির সঙ্গে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো সম্পর্কই ছিল না। যারা কম্পিউটারে প্রোগ্রাম লিখতে পারতেন তারাই কম্পিউটার স্পর্শ করতেন। একেবারে শুরুতে কম্পিউটারের প্রসারও খুবই সীমিত ছিল। আদমজী জুট মিলের মতো বড় প্রতিষ্ঠান, ইউনাইটেড বা হাবিব ব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট ইত্যাদি বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার বসতে থাকে। মূলত হিসাব-নিকাশ ছিল কম্পিউটারের প্রয়োগ ক্ষেত্র। যারা কম্পিউটারের সহায়তায় প্রোগ্রামিং করতে পারতেন তারাই ব্যবহার করতেন কম্পিউটার। তাছাড়া প্রোগ্রামিং কাজটাও সহজ ছিল না। তবে এটি উল্লেখ করতে হবে যে, ১৯৭৬ সালের আগে দুনিয়াতে ছোট কম্পিউটার তো ছিলই না। ফলে সারা দুনিয়ার চিত্রটাই এমন ছিল যে, বিশেষত গণনা কাজের জন্য কম্পিউটার ব্যবহৃত হতো এবং কেবলমাত্র প্রোগ্রামাররাই এসব যন্ত্র পরিচালনা করত।  ১৯৭৬ সালের পর দুনিয়াতে পিসির আবির্ভাব ঘটলেও তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়েনি। এপল সিরিজের কম্পিউটারগুলো এ দেশের সাধারণ মানুষের হাতে যায়নি। কেবলমাত্র ঢাকার আমেরিকান স্কুলে ব্যবহৃত হতো এগুলো। এমনকি ১৯৮১ সালে আইবিএম পিসি বাজারে আসার পরও এ দেশে পিসির ব্যবহার মোটেই বাড়েনি। কিছু কিছু লোক ওয়ার্ডস্টার, লোটাস আর ডিবেজ ব্যবহার করতেন বটে। তবে একে কোনোভাবেই জীবনের মূল স্রোতের সঙ্গে যুক্ত বলে ধরা যেত না।
 
ফলে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে যাতে সাধারণ মানুষ কম্পিউটার যন্ত্রটির ব্যবহারের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই সময়টাকে আমরা আদি বা প্রাথমিক যুগ হিসেবে সূচনা পর্বও বলতে পারি। এমনকি সেই সময়ে যারা বড় কম্পিউটারের বদলে পিসি ব্যবহার করতেন তারাও সংখ্যায় এত কম ছিলেন যে, সমাজে, রাষ্ট্রে বা অন্য কোনো স্তরে তার কোনো প্রভাব ছিল না। এই সময় সরকারের কোনো নীতিমালাই তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের জন্য সহায়ক ছিল না। কেউ ভাবেইনি যে, তথ্যপ্রযুক্তি নামক কোনো বিষয়ে সরকারের কিছু করার আছে। অথচ ভারত ১৯৮৬ সালে তাদের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রস্তুত করে ফেলে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে এত আগে কম্পিউটার আসার পরও নীতিনির্ধারক; আমলা ও রাজনীতিকদের এই অক্ষমতা কোনোভাবেই আমরা প্রশংসা করতে পারি না। বরং আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা নানা কারণে তাদের পূর্বপুরুষদের দৈন্যদশার জন্য নিজেরা লজ্জিত হবে। খুব সহজেই এই কথাটি ধরে নেয়া যায় যে, সেই সময়কার দেশের নীতিনির্ধারকদের মাঝে এই বিষয়ে সচেতনতা না থাকার ফলে আমরা ভবিষ্যতের কথাটি তখন বলতে পারিনি। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তিতে উপযুক্ত মানবসম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেই সময় যদি যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হতো তবে আজ আমরা কোনোভাবেই ভারতের পেছনে থাকতাম না।
 
বিবার্তা২৪.নেট: দ্বিতীয় অধ্যায়টি ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। এটি ডেস্কটপ প্রকাশনা ও বাংলা ভাষার বিপ্লবের যুগ। এ বিষয়ে যদি কিছু বলতেন?
 
মোস্তাফা জব্বার:  ডেস্কটপ প্রকাশনা ও বাংলা ভাষার পিসি যুগের শুরুটা একেবারেই সাদামাটাভাবে হয়েছিল। আশির দশকের শুরুতে কম্পিউটারে বাংলা ভাষা প্রচলনের উদ্যোগ নেয়া হতে থাকে। ১৯৮৬ সালে সাইফুদ্দাহার শহীদ মেকিন্টোস কম্পিউটারে বাংলা লেখার ব্যবস্থা প্রচলনও করেন। তবে ১৬ মে ১৯৮৭ কম্পিউটারে কম্পোজ করা একটি বাংলা পত্রিকা যার নাম আনন্দপত্র সেটি প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এই বিপ্লবের সূচনা হয়। এই বিপ্লবের দুটি প্রভাব ছিল। প্রথমত, এর ফলে কম্পিউটার ব্যবহার করে বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজ করার সূচনা হয়। দ্বিতীয়ত, এর ফলে সাধারণ মানুষের হাতে কম্পিউটার পৌঁছানোর প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে শুরু হয়। বাংলাদেশে এর আরো একটি ভিন্ন মাত্রা ছিল এ জন্য যে, সেই সময়টাতে প্রথমবারের মতো আমরা নিজেদের মতো করে মাতৃভাষা ব্যবহার করার সুযোগ পাই।
 
যদিও ১৯৮৬ সালে বা তারও আগে কম্পিউটারে বাংলার জন্ম হয় এবং ১৯৮৬ সালেই ডেস্কটপ পাবলিশিং প্রযুক্তিতে ঢাকা কুরিয়ার নামের একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশিত হয় তবুও আনন্দপত্র ডিটিপি বিপ্লবের আগুনের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে। এটি বস্তুত কম্পিউটারে বাংলা ব্যবহার করতে পারার জন্যই সম্ভব হয়েছে। তার চাইতেও বড় ঘটনা ঘটে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৮৮। সেই দিন বিজয় বাংলা কিবোর্ড ও সফটওয়্যার প্রকাশিত হয় এবং এরপর বাংলাদেশের কম্পিউটার প্রযুক্তি আর কখনো পেছনে ফিরে তাকায়নি। এই বিপ্লবের যে কটি বৈশিষ্ট্য ছিল তার মাঝে প্রধানটি হচ্ছে; সাধারণ মানুষের হাতে কম্পিউটার পৌঁছানো, সহজে কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারা, বাংলা ভাষায় কম্পিউটার চর্চা করতে পারা, সৃজনশীল কাজে কম্পিউটারকে ব্যবহার করতে পারা এবং শিক্ষায় কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারা। স্টিভ জবসের এ্যাপল কম্পিউটার কেবল বাংলাদেশেই এই বিপ্লবটি করেনি- কার্যত দুনিয়ার সর্বত্র এই বিপ্লবের সূচনা হয় মেকিন্টোস কম্পিউটারের হাত ধরে। আমাকে যদি বাংলাদেশে কম্পিউটার চর্চার সময়টিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে বলা হয় হবে ১৯৮৭ সালকেই আমি এর সূচনালগ্ন বলে চিহ্নিত করবো। এর আগের সময়টি কার্যত ছিল কম্পিউটার নিয়ে কিছু লোকের নাড়াচাড়া করার সময়। এই সময়ে কম্পিউটার তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছায়। বাংলা ভাষায় কম্পিউটার বিষয়ক বই-পত্রপত্রিকা ও সাময়িকী প্রকাশিত হতে থাকে এবং গণমাধ্যমের মূল স্রোতে কম্পিউটার প্রযুক্তি তার আসন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ১৯৮৯ সালে ঢাকার আমেরিকান স্কুলে প্রথম কম্পিউটার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সেই সময়েই চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ হোটেলে আয়োজিত হয় বাংলাদেশ কম্পিউটার ক্লাবের কম্পিউটার মেলা। ১৯৮৭ সালে জন্ম নেয় বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি যেটি ১৯৯২ সালে সরকারের কাছে নিবন্ধিত হয়। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি ঢাকায় আয়োজন করে কম্পিউটার মেলা।
 
এই সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের একটি বড় ঘটনা ঘটে যায় ডেস্কটপ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। ১৯৯২ সালে একটি দুঃখজনক ঘটনাও ঘটে। আমরা আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে চলমান সাবমেরিন ক্যাবল লাইনে যোগ দিইনি। আমাদের তখনকার নীতিনির্ধারকরা তখন মনে করেন যে, এর ফলে দেশের সব তথ্য পাচার হয়ে যাবে এবং দেশটির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। তখনকার বাংলাদেশের সরকার ১৯৯২ সালে একটি চরম ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই সময় আমাদের বঙ্গোপসাগর দিয়ে সি-মিউ-উই-৩ নামক সাবমেরিন ক্যাবল লাইন স্থাপিত হয়। তখন বাংলাদেশকে সেই সংযোগ গ্রহণ করার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু বিনামূল্যে সেই সংযোগ আমরা গ্রহণ করিনি। এর ফলে বাংলাদেশকে একটি দ্রুতগতির সংযোগ পাওয়ার জন্য ২০০৬ সালের মে মাস অবধি অপেক্ষা করতে হয়। এটি বাংলাদেশকে তথ্যপ্রযুক্তিতে দারুণভাবে পিছিয়ে ফেলে। অন্যদিকে দুনিয়াতে ইন্টারনেটের আগমন, উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের প্রসার এবং দ্রুতগতির প্রসেসরের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি একটি নতুন দিগন্ত প্রসারিত হয়।
 
বিবার্তা২৪.নেট:  ১৯৯৬-২০০১ সময়কে ধরা হয় তথ্যপ্রযুক্তির সুবর্ণযুগের ঊষালগ্ন –এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?
 
মোস্তাফা জব্বার: সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের সুবর্ণ সময়টির সূচনা হয় ১৯৯৬ সালের ২৩ জুনের পর। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ প্রথম অনলাইন ইন্টারনেটের যুগে প্রবেশ করে। এরপর ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ মোবাইলের মনোপলি ভাঙে। ১৯৯৬ সালেই দাবি ওঠে শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত কম্পিউটারের। ১৯৯৮ সালে সরকার কম্পিউটারের ওপর থেকে সব প্রকারের শুল্ক ও ভ্যাট তুলে নেয়। একই সময় সরকার জেআরসি কমিটির ৪৫টি সুপারিশ গ্রহণ করে এবং সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেই সুপারিশের অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে সরকার, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সেমিনারের আয়োজন করে যেখান থেকে বাংলাদেশ সফটওয়্যার ও সেবাখাত রপ্তানির এক নতুন পথে যাত্রা শুরু করে। ১৯৯৭ সালে জন্ম নেয় বেসিস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ২০০১ সালের বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল হওয়ার পর তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি সরকারের মনোযোগে ভাটা পড়ে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নামের সঙ্গে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শব্দটি যোগ করা, ২০০৩ সালের জেনেভায় তথ্যসমাজ সম্মেলনে যোগদান এবং ২০০৬ সালে সাবমেরিন ক্যাবলে যুক্ত হওয়া ছাড়া সেই সময়কার সরকার কেবল শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত কম্পিউটারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এই পাঁচ বছরেও যদি ১৯৯৬-০১ সালের মতো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি গুরুত্ব পেতো তবে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির অভিযাত্রা আরো মসৃণ হতে পারত। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলনামূলকভাবে বেগম জিয়ার সরকারের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দিলেও বিষয়টিতে তাদের সর্বোচ্চ নজর ছিল না। এই সরকারের আমলের সবচেয়ে বড় কাজের একটি হচ্ছে ছবিসহ ডিজিটাল ভোটার তালিকা প্রণয়ন। এই সরকার একটি আইসিটি নীতিমালার খসড়াও তৈরি করে। এই আমলেই স্কুল-কলেজে কম্পিউটারকে বাধ্যতামূলক করার সুপারিশও করা হয়। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সময়কালটি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিকাশের মধ্য গগনের সময়। একে আমাদের স্বর্ণযুগ বললে ভুল বলা হবে না।
 
বিবার্তা২৪.নেট:  আপনি কর্মজীবন শুরু করেছেন সাংবাদিকতার মধ্যে দিয়ে। সেই দিনগুলোর কথা কিছু বলুন?
 
মোস্তাফা জব্বার: ১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় এসে গণকণ্ঠে যোগ দিলাম। ৭২ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে ৭৫ সালের ২০ জানুয়ারি হচ্ছে সরাসরি গণকণ্ঠে কাজ করার সময়। গণকণ্ঠে থাকার সময় লুৎফর রহমান রিটন, নাসির আহমেদের মতো বহু কবি-সাহিত্যিককে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছি। এছাড়াও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। লোহানী (কামাল লোহানী) ভাই, ইকবাল সোবহান (ইকবাল সোবহান চৌধুরী) ভাই, নির্মলদা (নির্মল সেন), গিয়াস কামাল চৌধুরী -তখনকার দিনে যাঁরা সাংবাদিক নেতা ছিলেন, প্রত্যেকের সঙ্গে কাজ করেছি। এ জীবন আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে, কতগুলো জায়গায় কিছু অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জন করেছি। মুদ্রণ ও প্রকাশনা সম্পর্কে জ্ঞান ওখান থেকেই। এই যে আজকে কম্পিউটার নিয়ে কাজ করি, তার একটা ভিত্তি গণকণ্ঠ। গণকণ্ঠে যদি না থাকতাম তাহলে বাংলা অক্ষর চিনতাম না, কম্পোজ কাকে বলে জানতাম না। গণকণ্ঠ আমাকে অনেক দিয়েছে। বাংলা ভাষা প্রীতি, দেশের প্রতি দরদ, কমিটমেন্ট-যা কিছু হোক না কেন, সে ভিত্তি  তৈরি হয়েছে গণকণ্ঠে।
 
বিবার্তা২৪.নেট:  আপনার প্রকাশনা জীবনের কথা বলুন?
 
মোস্তাফা জব্বার:  এই সময়টা আমার জন্য খুব চ্যালেঞ্জিং। কারণ তখন টেকনোলজি নিয়ে কাজ শুরু করলাম। নিপুণের একটা বিষয় ছিল বলতে পারি, বাংলাদেশের কোনো সাময়িক পত্রিকা এত ডিটেইল, এত সুন্দর কভার স্টোরি করেনি। তখনকার দিনের একটা সিনেমা পত্রিকাকে ম্যাগাজিনে রূপান্তর করলাম। কালার প্রিন্টিংয়ের সূচনা করলাম। আমার ধারণা, এ ব্যাপারটিই বাংলাদেশের সংবাদপত্রের জগৎকে বদলেছে। আমার সঙ্গে কাজ করতেন কবি অসীম সাহা, ফটোগ্রাফার ছিলেন নাসির আলী মামুন। এখান থেকেই ওর যাত্রা শুরু। নিপুণের জন্য রুমের মধ্যে আফজাল হোসেনকে বসিয়ে রেখে উপন্যাস লিখিয়েছি। ইমদাদুল হক মিলনকে দিয়ে উপন্যাস লিখিয়েছি। এটা আমার বড় একটি ভিত তৈরি করে দিয়েছে এই অর্থে, তখন থেকে সিরিয়াসলি মুদ্রণ সমস্যার সঙ্গে পরিচিত হতে থাকি। এ সময় দুটি কাজ হল। এক সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগল। দ্বিতীয়ত প্রযুক্তির প্রতি ঝোঁক তৈরি হলো। ১৯৮৭ সালে সাপ্তাহিক পত্রিকা করব বলে কম্পিউটারের জগতে প্রবেশ করলাম। তখনো টেকনোলজি জানি না। ১৯৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল প্রথম কম্পিউটার নিয়ে এসে অন করলাম। পত্রিকা প্রকাশের সময় মনে হলো, সিসার হরফে পত্রিকা করব না, কম্পিউটার দিয়ে করব। সে জন্য কম্পিউটার কিনলাম। সেটা ব্যবহার করে মে মাসের ১৬ তারিখে আনন্দপত্র প্রকাশিত হলো।
 
বিবার্তা২৪.নেট:  আপনি তো কম্পিউটারে বাংলা লেখার সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেছেন। আনন্দ ফন্ট পাওয়ার গল্পটা জানতে চাই।
 
মোস্তাফা জব্বার:  বলতে গেলে তো অনেক কথাই বলতে হয়। আমাকে বাংলা ফন্ট দিয়েছিলেন সৈয়দ মাইনুল হাসান (তিনি তখন বিজনেস অ্যান্ড এডুকেশন সিস্টেমস লিমিটেড নামের একটি কম্পিউটার বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন)। তাঁর সঙ্গে একটা ব্যবসা শুরু করব-এমন ভাবনা ছিল। কিন্তু তিনি বাংলা হরফ বানিয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে বিজনেস করব না। আমার কাছে তখন লেজার প্রিন্টার এসেছে। কম্পোজ করে সার্কিট হাউস রোডে প্রিন্ট আউট করতাম। মাইনুলকে গিয়ে বললাম, বাংলা ফন্টটা দেন। আমি প্রিন্ট করব। বললেন-না, দেব না। ফলে ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে নিজেই ফন্ট তৈরিতে হাত দিলাম এবং সে মাসেই আমার প্রথম ফন্ট বের হলো আনন্দ। তবে এই কাজটি আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল। কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। কোনো কিছু চিনি না, জানি না। কম্পিউটার কাকে বলে তাও জানি না। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে কম্পিউটার শিখতে গিয়েছিলাম। প্রথম ক্লাসে বক্তৃতা শুনে মনে হলো, কিছুই বুঝি না। বাইনারি অঙ্ক পড়াচ্ছিলেন। স্যারকে জিজ্ঞেস করলাম-স্যার পরের ক্লাসগুলোও কী এ রকমই হবে? বললেন, হ্যাঁ, বাইনারি অঙ্ক না বুঝলে কম্পিউটার কিছুই বুঝবে না। বললাম, স্যার থ্যাঙ্ক ইউ। আর ক্লাস করিনি। নিজের কম্পিউটার থাকায় সুবিধা হয়েছিল, নিজে চালু করলাম, অপারেট করা শিখলাম। এটি দিয়েই পত্রিকা বের করলাম, আয়ত্তেও এসে গেল।
 
বিবার্তা২৪.নেট:   বাংলা ফন্টের শুরুর কথা যদি বলতেন?
 
মোস্তাফা জব্বার: আনন্দ তৈরির পর মনে হলো, যদি ব্যবসা ও পত্রিকায় ভালো করতে চাই, তাহলে হরফ সুন্দর না হলে হবে না। ভালো হরফ করতে না পারলে কম্পিউটারে ব্যবহার করা যাবে না। প্রথম কম্পিউটারে স্পর্শ করার সময়ই মনে হয়েছিল, বাংলা অক্ষরমালা যদি সুন্দর না হয়, তাহলে বাংলা প্রকাশনা সুন্দর হবে না। সে জন্যই শুরু করতে হলো। আনন্দপত্রে প্রথম আনন্দ ফন্ট ব্যবহার করলাম। ১৯৮৭ সালেই দৈনিক আজাদ প্রথম ফন্টটা ব্যবহার শুরু করল। আস্তে আস্তে দৈনিক দেশ, বাংলার বাণী এবং সবাই ব্যবহার করল। আনন্দ ফন্টই পরে ১৯৮৮ সালে সুনন্দা হয়েছে, সুনন্দা থেকে সুতন্বী (১৯৮৮ সালে)। আস্তে আস্তে উন্নয়ন করে করে ফন্টটি আজকের রূপে এনেছি। এটি ২৮ বছরের ইতিহাস।
 
বিবার্তা২৪.নেট: ওই ইতিহাসটাই বলুন।
 
মোস্তাফা জব্বার:  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বাংলা বিভাগের এক বছরের জুনিয়র হামিদুল ইসলাম তখন দৈনিক আজাদে শিল্প নিন্দেশক। ১৯৮৭ সালে ওকে ধরে নিয়ে আসলাম, তুমি আমার জন্য অক্ষর ডিজাইন করে দেবে। তখন ফটো কম্পোজের যুগ। ফটো কম্পোজের যে অক্ষরগুলো ছিল, সেগুলো প্রিন্ট দিয়ে হামিদকে দিলাম। বললাম, আমি তো এটার হুবহু ব্যবহার করতে পারব না। তাতে কপিরাইট লঙ্ঘন হবে। এটার মতো করে একটা ফন্ট ডিজাইন করে দাও। ও সেলোফিন পেপারের (স্বচ্ছ পাতলা  র্যা পিং কাগজ, একসময়ে মুদ্রণে ব্যবহৃত হতো) ওপর লাইনার দিয়ে এঁকে শেপ করে দিত। আমি স্কচ টেপ দিয়ে কম্পিউটারের পন্দায় লাগাতাম। মাউস দিয়ে ডিজিটাইজ করতাম। তখন স্ক্যানার ছিল না। ১৯৮৭ সালে প্রকাশের পর দেখি, পত্রিকা প্রকাশনা শিল্প দ্রুত ফন্টটি গ্রহণ করে ফেলল। তবে কয়েক দিন পরে  দৈনিকগুলো অভিযোগ করল, ১৮৮টি অক্ষর মনে রেখে তাড়াতাড়ি পত্রিকা বের করতে পারি না। টাইপিস্টদের সঙ্গে কথা বললাম। তাঁরা বললেন, স্যার আমরা নরমাল, শিফট, অপশন, শিফট অপশন-এ চারটি অপশন দিয়ে কাজ করি। ফলে টাইপ বেশি হয় না। তখন মাথায় ঢুকল, চার লেয়ারের কি বোর্ডকে দুই লেয়ারে আনতে হবে। সে জন্য ১৯৮৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গবেষণা করেছি (আমার কাছে শহীদ মুনীর চৌধুরীর টাইপরাইটারের কি বোর্ড বানানোর কিছু গবেষণা ছিল। সেগুলো দিয়েই অপটিমা মুনীর টাইপরাইটার  তৈরি হয়)। বাংলা যুক্তাক্ষর থেকে শুরু করে সব কিছুর পৌনঃপুনিকতা পর্যালোচনা করে বিজয় কি বোর্ড বানালাম এবং ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় আত্মপ্রকাশ করল। বিজয় বানানোর জন্য দেশে কোনো প্রোগ্রামার পাইনি। দিল্লি থেকে তৈরি করে এনেছি। আমার মনে হয়, আজকের বাংলার বিপ্লবটা হচ্ছে বিজয়ের। প্রথমে ৪৫৪টি সিসার হরফে বাংলা লেখা হতো। সেগুলোকে মাত্র ৫৫টি হরফে নিয়ে এলাম। এই ৫৫টি হরফ যদি কেউ জানেন, তাহলে তিনি কম্পিউটারে বাংলা লিখতে পারবেন। বাকিগুলো মনে রাখার দরকার নেই, একটি যুক্তাক্ষরও মনে রাখার দরকার নেই। বিজয়ের মাধ্যমে পত্রিকা জগতের বিপ্লবটি হলো, আগে কম্পোজাররা মিনিটে যদি ইংরেজি অক্ষর ৪০টি টাইপ করতে পারতেন, একই সময়ে বাংলা অক্ষর টাইপ করতে পারতেন মাত্র ২০টি। বিজয়ের পরে দেখা গেল, ইংরেজি ৪০টি করলে বাংলা ৬০টি করতে পারছেন। এই গতি আমার জন্য একটি ফ্যাক্টর। টাইপিস্ট ও অপারেটররা খুব দ্রুত বিজয় আয়ত্ত করেছেন। তবে বিজয়ের কাজ এখনো শেষ হয়নি। ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিয়মিতভাবে অপারেটিং ব্যবস্থা বদলে যাচ্ছে, অ্যাপ্লিকেশন বদলে যাচ্ছে, সেটার সঙ্গে বিজয়কে নিয়মিত উন্নয়নের কাজ করছি।
 
বিবার্তা২৪.নেট:  বর্তমান সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কতটুকু সম্ভব হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
 
মোস্তাফা জব্বার:  আমার মতে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে যে অর্থে নেয়া উচিত সে অর্থে নেয়া হয় নি। যদি নেয়া হতো তাহলে গত সাড়ে ছয় বছরে শিক্ষা ব্যবস্থার আরও অনেক প্রযুক্তিনির্ভর হতো। তবে সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় পাঠ্যসূচিতে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়টি যুক্ত করেছে। এটা একটা মাইলফলক স্বরূপ। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থাকে যদি বলি ডিজিটাল করার কথা তাহলে ৫০ নম্বরে পড়াইলাম আর প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা বহাল রাখলাম এটা তো যথেষ্ট না। আসল কথা হলো আমরা ছাত্রছাত্রীদের যে পদ্ধতিতে শিক্ষা দিচ্ছি সেই পদ্ধতিটা পরিবর্তন করতে হেবে। যেমন খাতা-কলম, বই-খাতা, চক-ব্লাকবোর্ড, ডাস্টার এগুলোর পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। সারা দুনিয়াতে কিন্তু শিক্ষার ধরণ বদলে গেছে। আর এর জন্য একটা পেটার্ন তৈরি করতে হবে। আমাদের দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা অনেক। কেউ  বিএ পাস করছে, এমএ পাস করছে কিন্তু চাকুরি পাচ্ছে না। কারণ তাদের পেশাগত শিক্ষা নেই। তাদেরকে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত করলে তাদের আর বেকার থাকতে হতো না। এখন দরকার উন্নত দেশের মতো করে বই খাতাবিহীন প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন।
 
বিবার্তা২৪.নেট:  আপনি তো ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার পথিকৃৎ বা ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সরকার কতটুকু সফল হয়েছে।
 
মোস্তাফা জব্বার: আমার মতে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে অনেকটা সফল হয়েছে। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি দিক দিয়ে  বাংলাদেশে অনেক পিছিয়ে ছিল। বলতে গেলে প্রযুক্তিশীল দেশগুলোর তুলনায় ৩০০ বছর পিছিয়ে ছিল। যেমন জার্মানিতে ১৮৫৪ সালে যেখানে তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেকটা এগিয়ে ছিল সে দিক থেকে আমাদের দেশের প্রাথমিক আবর্জনা সরাতেই অনেক সময় চলে গেছে। তাহলে ৩০০ বছরে পিছিয়ে থাকাটা আমরা ১৯৮৫ সালে কমিয়ে ২০০ বছরে নিয়ে এসেছি। প্রথম দিকে দেশকে প্রযুক্তিনির্ভর করতে সরকারের দিক থেকে তেমন কোন কার্যক্রম ছিল না। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সরকার এব্যাপারে কোন ইতিবাচক সারা ছিল না। এর পরে সরকারকে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে বুঝাইতে বুঝাইতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। তারপরে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলাম। পরে ২০০০ সালে আসল আরেক সরকার। এভাবে চলেতে থাকলো। সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় হচ্ছে ২০০৯ সালের পরের সময়টি। ২০০৭ সালে আমরা প্রথমবারের মতো ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করি। ২০০৮ সালেও আমরা একই বক্তব্য প্রকাশ করি। সেই বছরের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার দলের ইশতেহার প্রকাশ করেন। তিনি তাতে ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার ও কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেই নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর শেখ হাসিনার সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কর্মসূচি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়। ২০০৯ সালের শুরুতেই গ্রহণ করা হয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা।  ২০০৮ গিয়ে একটা নতুন জায়গায় আনা সম্ভব হলো। বলা যায় ২০০৮ থেকেই শুরু হয় ভাল কেরে। কিন্তু ৬ বা সাড়ে ছয় বছর কিন্তু একটা সরকারের জন্য বেশি সময় না। তবে এই সময়টাতে অনেক অর্জন সম্ভব হয়েছে। সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাংলাদেশের সব শ্রেণির মানুষ তো আর তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে ভাবে না। এমনকি ব্যবহারও করে না। তবে সার্বিক দিক বিবেচনা করলে যা হয়েছে অনেকটা এগিয়েছে।
 
বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকার ধারাবাহিকভাবে অনেকগুলো মাইলফলক কাজ করেছে। যেমন- ‘জনগণের দোরগোড়ায় সেবা’- এই স্লোগানটি নিযে  ইউনিয়ন পর্যায়ে তথ্য ও সেবাকেন্দ্র স্থাপন করে সেখান থেকে গ্রামের মানুষকে সরকারি সেবা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।  জেলা পর্যায়ের সরকারি অফিসসহ উপজেলা স্তরের অফিসগুলোর ডিজিটাল রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে। জেলায় ডিজিটাল পদ্ধতির সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গড়ে উঠেছে কম্পিউটার ল্যাব ও ডিজিটাল ক্লাসরুম। তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল কনটেন্টস। প্রশিক্ষিত হচ্ছে শিক্ষকরা। ফটওয়্যার ও সেবা খাতে রপ্তানি বেড়েছে। অন্তত ৩০ হাজার দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার কর্মসূচি হাতে নিয়ে সফটওয়্যার পার্ক, হাইটেক পার্ক ও ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মোবাইল ব্যাংকিং-এর ব্যাপক প্রসারের পাশাপাশি মোবাইলভিত্তিক সেবার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে।  ডাক, টেলিযোগাযোগ ও আইসিটি মন্ত্রণালয় নামে ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নামক দুটি মন্ত্রণালয়কে একীভূত করে এই খাতের গুরুত্বকে অনুধাবন করে সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। আইসিটি ডিভিশন নামক একটি নতুন ডিভিশন চালু করা হয়েছে।
 
ইতিবাচক কাজের মাঝে আরো অনেক কিছুর কথা বলা যাবে। আইসিটি পলিসি, ডিজিটাল কেন্দ্র, ডিজিটাল মেলা ছাড়াও জীবনধারায় ডিজিটাল পদ্ধতির প্রসারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে।
 
বিবার্তা২৪.নেট: তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমরা প্রিন্ট, ব্রডকাস্ট ও অনলাইন মিডিয়ার সেবা পাচ্ছি। ৩টি মিডিয়ার মধ্যে অনলাইন মিডিয়া নিয়ে যদি কিছু বলতেন।
 
মোস্তাফা জব্বার:   অনলাইন মিডিয়ার বিষয়টা হলো যখন ঘটনা ঘটে তখনই নিউজ। এটা একটা গতিশীল মিডিয়া। তথ্য সম্প্রচারে অন্যান্য মিডিয়ার মতো অনলাইন মিডিয়ার ভূমিকাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে অনেকগুলো ভাল অনলাইন নিউজ পোর্টাল দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে। তবে এ ব্যাপারে সরকারের দরকার সচেতন থাকা। এটা পরিচালনা করার জন্য একটা নীতিমালা থাকা দরকার। নিদিষ্ট নীতিমালা থাকলে নিয়মের মধ্যে থেকে অনলাইন মিডিয়াগুলো আরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে সক্ষম হবে।
 
বিবার্তা২৪.নেট:  কম্পিউটার শিক্ষাকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার অবদান  বিষয়ে বলুন।
 
মোস্তাফা জব্বার: ১৯৮৭ সালে যখন ব্যবসা শুরু করেছিলাম, এ দেশের লোকজন কম্পিউটার চেনেই না। এই ২৮ বছরে মানুষকে কম্পিউটার চেনানো, কম্পিউটারের বিপ্লবের কাজটি করেছি। ১৯৮৭ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সারা দেশে আমার ৩০টি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানে এমন মানুষ তৈরি করা হয়েছে। ১৯৯২ সালে শিক্ষা ক্ষেত্রে কম্পিউটারের প্রচলনের উদ্যোগ শুরু করলাম। কেবল ট্রেনিংপ্রাপ্ত জনবল তৈরি করলে হবে না, কম্পিউটারকে এডুকেশনের পার্ট হতে হবে। ১৯৯২ সালে প্রথম কম্পিউটারকে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে বলে দাবি তুলেছি, উদ্যোগ নিয়েছি। ১৯৯২ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত সিলেবাস বই তৈরি হলো। ১৯৯৬ সালে ক্লাস নাইনে আমার মাধ্যমিক কম্পিউটার শিক্ষা পাঠ্য হলো। ১৯৯৮ সালে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে উচ্চ মাধ্যমিক কম্পিউটার শিক্ষা পাঠ্য হলো। এখন ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক। ২০১০ সালে শিক্ষানীতি হয়েছে। সেখানে কম্পিউটার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হোক সুপারিশ করেছি। ফলে ২০১১ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে কম্পিউটার শেখা বাধ্যতামূলক করা হলো। এখন ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রত্যেককে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি পড়তে হয়। কম্পিউটারকে এডুকেশনের পার্ট করার এই ফাইটটি আমার। ব্যক্তিগতভাবে ১৯৯৯ সালে গাজীপুরে আনন্দ মাল্টিমিডিয়া স্কুল তৈরি করে ২০০০ সালে শিশু শ্রেণি থেকে বাধ্যতামূলকভাবে কম্পিউটারের মাধ্যমে লেখাপড়া করার ব্যবস্থা করেছি। এখনো ১২টি স্কুল আছে। প্রজেক্টর দিয়ে, কম্পিউটারের মাধ্যমে লেখাপড়া করানো হয়।
 
বিবার্তা২৪.নেট:  আপনার জীবনের অন্যান্য সফলতা বিষয়ে বলুন।
 
মোস্তাফা জব্বার: আমার জন্ম ১৯৪৯ সালের ১২ আগস্ট আশুগঞ্জের চর চারতলা গ্রামের নানার বাড়িতে। পৈতৃক নিবাস নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে।  আমি কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ওঠে এসেছি এবং শূন্য খেকে সব কিছু শুরু করেছি। আমি চেয়েছি সবাই যেন শিক্ষিত হয়। এই লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ি থানার প্রথম হাই স্কুল করার উদ্যোগ নিলাম। ১৯৭০ সালে মাত্র ছয়জন ছাত্র নিয়ে স্কুলটি চালু হলো এবং একাত্তরে যুদ্ধের সময় বন্ধ হয়ে গেল। ১৯৭২ সালে বাবা (আবদুল জব্বার তালুকদার) আলীমুদ্দীন-আরজেন্নেসা স্কুলের হাল ধরেন। এখন সেটি এলাকার অন্যতম সেরা স্কুল। ১৯৮৬ সালে গ্রামে কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে মানুষ বিশ্বাস করতেই পারেনি, গ্রামে কলেজ হতে পারে, আশপাশের থানা-সদরেও কলেজ নেই। মনে আছে, ১০ হাজার টাকা দিয়ে টিনের ঘর করে কৃষ্ণপুর হাজি আলী আকবর পাবলিক ডিগ্রি কলেজ চালু করেছি। সেখানে এখন মাস্টার্স পড়ানো হয়।  ১৯৯৬ সালে মা-বাবার নামে আবদুল জব্বার-রাবেয়া খাতুন বালিকা বিদ্যালয় চালু করলাম। গত জুনে বাড়ি গিয়েছিলাম। আমার স্কুলে এখন ৪০০ থেকে ৫০০ মেয়ে পড়াশোনা করে।
 
বিবার্তা২৪.নেট: আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য বিবার্তা২৪.নেটের পক্ষ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মোস্তাফা জব্বার:   আপনাকেও ধন্যবাদ।
 
বিবার্তা/এমএইচ/
 
সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

৪৬, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ

কারওয়ান বাজার (২য় তলা), ঢাকা-১২১৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১১৯২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com