ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া। ডেনমার্ক প্রবাসী চিকিৎসক। পেশায় চিকিৎসক হলেও মননে তিনি রাজনীতিক। ডেনমার্ক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। একসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি ও সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন ছাত্রলীগ ঢামেক শাখার আহ্বায়ক। ২০০৬ সালে ছিলেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) ঢামেক শাখার সভাপতি।
২০০৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করে পাড়ি দেন সুইডেন। সেখানকার ক্যারোলিনস্কা ইউনিভার্সিটি থেকে এমডি করেছেন প্রিভেন্টিভ মেডিসিনে। পরে পাবলিক হেলথ নিয়ে সম্পন্ন করেন এমপিএইচ ডিগ্রি।
ডেনমার্কে থিতু হওয়া বিদ্যুৎ বড়ুয়া হেলথ টেক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সিইও হিসেবে কর্মরত। বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকলেও দেশ নিয়ে তার ভাবনায় কখনও ছেদ পড়ে না। বর্তমানে তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন। রবিবার সন্ধ্যায় বিবার্তা২৪.নেট-এর কার্যালয় পরিদর্শনে এসে জানালেন দেশ নিয়ে তার স্বপ্নের কথা, ভাবনার কথা। বিবার্তার পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো-
বিবার্তা: অনেক দিন পর দেশে ফিরলেন। কেমন লাগছে। কী পরিবর্তন দেখছেন দেশের। ভালো-মন্দ...
বিদ্যুৎ বড়ুয়া: দেড় বছর পর দেশে ফিরেছি। দেশে অবকাঠামোগত যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের অভিব্যক্তিতেও যথেষ্ট পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। বেড়েছে পেশাদারিত্বের মনোভাব। সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটি অবশ্যই ইতিবাচক।
বিবার্তা: বাংলাদেশ ও ডেনমার্কের মধ্যে অনেক পার্থক্য তো স্বাভাবিকভাবেই আছে। সমাজ, রাজনীতি, আইনশৃঙ্খলা, দেশশাসন... আপনি আমাদের পাঠকদের এসব বিষয়ে কি কিছু জানাবেন?
বিদ্যুৎ বড়ুয়া: আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ডেনমার্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য অনেক। ডেনমার্কের জনসংখ্যা মাত্র ৫৫ লাখ। আমাদের রাজধানীর মিরপুরের চেয়েও কম। তবে সেখানে সবাই প্রায় প্রযুক্তিগত নেটওয়ার্কের আওতায়। প্রশাসনও নাগরিকদের নিরাপত্তাসহ সার্বিক বিষয় সহজেই দেখভাল করতে পারে। তবে এমনিতেই ওই দেশের জনগণের মধ্যে আইন মেনে চলার প্রবণতা রয়েছে।
সে তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক বেশি। আমরা সবেমাত্র নিম্নআয়ের অবস্থান কাটিয়ে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছি। কিন্তু এখনও আমাদের মধ্যে আইন মেনে চলার মনোভাব সে অর্থে গড়ে ওঠেনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি।
শাহবাগ থেকে গাড়িতে যাত্রা করে সেনানিবাসের জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত কোনো শৃঙ্খলা দেখতে পেলাম না। অথচ জাহাঙ্গীর গেটের ভেতর প্রবেশ করেই সব গাড়িগুলো কেমন সুশৃঙ্খল হয়ে উঠলো। তাহলে কি আমরা এটা বুঝবো যে, বাধ্য না হলে আমরা নিয়ম-কানুন মানতে অভ্যস্ত নই? আসলে এ বিষয়গুলোতে প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে।
বিবার্তা: ডেনমার্কে প্রবাসী বাংলাদেশীরা এবং অন্যান্য দেশের অভিবাসীরা কেমন আছেন? এ ব্যাপারে ওই দেশের সরকারের নীতি কেমন?
বিদ্যুৎ বড়ুয়া: আসলে অভিবাসী বলতে তো আর শুধু ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মানুষকে বোঝায় না। একসময় ডেনমার্কে অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজ ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে অনেক কিছুই বদলে গেছে। আপনারা জানেন, ফ্রান্স, লন্ডন, বেলজিয়ামসহ ইউরোপের বেশ কিছু দেশে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। সঙ্গত কারণেই অভিবাসনের ক্ষেত্রে বর্তমানে দেশগুলো অনেক কঠোর।
বিবার্তা: বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উপদ্রব শুরু হয়েছে, তা তো দেখলেনই। এই অশুভ প্রবণতা ঠেকাতে সরকার ও জনগণ কী করতে পারে বলে আপনি মনে করেন? এ ব্যাপারে অন্য প্রবাসীদেরই বা চিন্তা-ভাবনা কী?
বিদ্যুৎ বড়ুয়া: বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উদ্ভব কম-বেশি ১০ বছর। আসলে উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধের কোনো জায়গাই এখন জঙ্গিবাদের থাবার বাইরে নয়। এটা বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বনেতাদেরকে একজোট হয়েই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলগুলোকে এ ইস্যুতে সমানভাবে আন্তরিক হতে হবে। শুধু ক্ষমতার মোহ নিয়ে রাজনীতি করলে জাতীয় এ সঙ্কট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
প্রবাসীদের ভাবনার কথা বললে বলতে হয়, আপনার ও আমার ভাবনার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। কারণ আমি হয়তো বিদেশে আছি। ভালো আছি। কিন্তু আমার সব স্বজনতো দেশে। তারা ভালো না থাকলে আমরাও প্রবাসে ভালো থাকতে পারি না। এক্ষেত্রে আমাদের অনুভূতি একই।
বিবার্তা: প্রবাসে দেশীয় সংস্কৃতি লালন, সাহিত্য চর্চা ও সাংবাদিকতার কী অবস্থা? নাকি সবাই আপন কাজে ব্যস্ত...
বিদ্যুৎ বড়ুয়া: আপনারা জানেন, প্রবাসীদেরও ৮ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। এরপর যারা পরিবার নিয়ে থাকেন, সেখানে সময় দিতে হয়। তারপরই ব্যক্তিগত অবকাশের কথা আসে। সাধারণত জাতীয় দিবসগুলো পালনে প্রবাসীরা কখনও কার্পণ্য করেন না। বিশেষ করে পয়লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসের কর্মসূচিতে একাকার হন প্রবাসী বাংলাদেশীরা।
অন্যদিকে সাহিত্য চর্চার পরিসর খুব বড় নয়। আমি হয়তো ব্যক্তিগতভাবে পাঠাগার গড়ে তুলেছি। কারণ আমার পাঠাভ্যাসটি পুরনো। ডেনমার্কের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে বাংলাদেশী, বাংলা ভাষার কিছু বই-পুস্তক রয়েছে। তবে আমাদের দূতাবাস উদ্যোগ নিলে এক্ষেত্রে পরিসর আরো বাড়ানো সম্ভব।
বিবার্তা: প্রবাসে বসে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য কি কিছু করা যায়। এরকম কোনো পরিকল্পনা কি কারো আছে?
বিদ্যুৎ বড়ুয়া: অন্যের কথা জানি না। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য আমার নিজের কিছু পরিকল্পনার কথা বলতে পারি। যেহেতু আমি চিকিৎসক, তাই স্বাস্থ্যসেবা নিয়েই আমি কাজ করতে চাই। আর সে লক্ষ্যে একটি হেলথ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম নিয়ে আমি কাজ করছি। ইতোমধ্যে আমি ডেনমার্কে হেলথ টেক ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি।
আমার লক্ষ্য দেশের মানুষের একটি স্বাস্থ্যগত রেকর্ড সংরক্ষণের ব্যবস্থা গড়ে তোলা। যাতে একবার কোনো রোগী নিবন্ধিত হলে আজীবন তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নথির রেকর্ড থাকবে। এতে সহজেই সেই রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব। ডেনমার্কে এমন ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
বিবার্তা: আবার তো ফিরে যাবেন। পাঠকদের উদ্দেশে কিছু বলবেন কি...
বিদ্যুৎ বড়ুয়া: এখন অনলাইনের যুগ। পাঠক বলতে তো সারা দেশের মানুষকেই বুঝি। বর্তমান পরিস্থিতিতে আসলে সারাদেশের মানুষই উদ্বিগ্ন। তবে আমি মনে করে ভিত-সন্ত্রস্ত না হয়ে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে হবে। সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। আমরা প্রবাসে ও আপনারা দেশে থেকে কাজ করলে সঙ্কট কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব নয়। সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, দেশটা আপনার, আমার, সবার। তাই দেশের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকবে হবে। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ ব্যর্থ হতে পারে না।
বিবার্তা/রোকন/কাফী