ওয়েব, সফটওয়ার, এসইও, অ্যাপস ডেভেলপমেন্ট কাজকে কেবল আয়ের উৎস নয়, শিল্প ভেবেই সেই শিল্প শেখা ও বোঝার উদ্দেশ্যে ফ্রিল্যান্সিং জগতে পা রাখেন মো. তরিকুল ইসলাম কিরন। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ে হাতে খড়ি ২০১০ সালে। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটি বাংলাদেশ থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড সফটওয়্যার প্রকৌশল বিষয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন। অন্যের অধীনে কাজ করার আশা না করে নিজে উদ্যোক্তা হয়ে কিছু করার স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেছিলেন অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয়। শুরুতে তেমন সফলতা না পেলেও এখন সফলতা পেয়েছেন। বর্তমানে তিনি গিকসএনটেকনোলজি (geekntechnology Limited) আমেরিকা ভিত্তিক ফটওয়্যার কোম্পানির প্রধান নির্বাহী অফিসার (সিইও)।
বুধবার রাজধানীর মহাখালির ডিওএইচএস গিকসএনটেকনোলজি, বাংলাদেশ অফিসে ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বিবার্তা২৪.নেটের নিজস্ব প্রতিবেদক- উজ্জ্বল এ গমেজ।
বিবার্তা২৪.নেটঃ বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং সম্ভাবনা নিয়ে কিছু বলুন।
মো. তরিকুল ইসলামঃ বর্তমানে তরুণদের জন্য স্মার্ট পেশা হলো ফ্রিল্যান্সিং। বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং সম্ভাবনা অনেক ভাল। বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্বমানের এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অনেক সফল ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। যাদের সফলতার গল্প শুনে অনেকেই নতুন করে ফ্রিল্যান্সিং এ আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা সুখবর। এক সময় ছিল যখন এই পেশার অবস্থা ভাল ছিল না। অনেক সংগ্রাম করে নানা প্রতিকূল পারিবেশের মধ্য দিয়ে বর্তমানের এই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যারা বেকার রয়েছেন তাদের জন্য অনেক বেশি সম্ভাবনাময় পেশা ফ্রিল্যান্সিং।
বর্তমান সরকার দেশের আইসিটি সেক্টরকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। এর ফলে বেকার তরুণ তরুণীরা ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের উদ্যোগে কাজ করছে। কেউ আউটসোর্সিং এর কাজ করছেন। আবার কেউ কোন ভাল প্রতিষ্ঠানে ভাল চাকুরি করে সুন্দরভাবে জীবনযাপন করছেন। কেউ নিজে ওয়েবসাইট তৈরি করে নিজের পণ্য বিক্রি করছেন আবার অন্যদেরও সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছেন।
বিবার্তা২৪.নেটঃ ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে কি কি সমস্যা রয়েছে?
মো. তরিকুল ইসলামঃ অনেক সম্ভাবনা এবং সফলতার মধ্যেও বেশ কিছু সমস্যাও আছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল সরকারি ও বেসরকারি উভয় জায়গা হতেই প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অভাব রয়েছে। যদিও সরকার ইতোমধ্যে আইসিটি সেক্টরে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরু করেছেন। তবুও কোন কোন এলাকায় আছে দ্রুত গতির ইন্টারনেট সার্ভিসের অভাব, বিদ্যুৎ ঘাটতি, অপর্যাপ্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইত্যাদি। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই সম্ভাবনা এবং সফলতার গল্পগুলোকে ব্যবহার করে কিছু অসাধু লোক বিভিন্ন নামে ভুয়া ট্রেনিং সেন্টার খুলে বসেছে। সেখানে অল্প জানা ট্রেইনাররা আগ্রহীদেরকে ভুলভাল কাজ শেখাচ্ছেন। এতে অনেক তরুণ প্রতারিত হয়ে হতাশ হচ্ছেন।
বিবার্তা২৪.নেটঃ সমস্যা সমাধানের উপায় কি?
মো. তরিকুল ইসলামঃ আমার মতে ফ্রিল্যান্সিং পেশার এ সমস্যা কারো একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব না। বাংলাদেশে অনেক ফ্রিল্যান্সার আছেন, যাঁরা সফলভাবে কাজ করছেন। বাইরে থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। এই সফল ব্যক্তিসহ যারা আইসিটি বিষয়ে অভিজ্ঞ তাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। যাঁরা দক্ষ ও অভিজ্ঞ তাদের উচিত এই ব্যাপরে সহযোগিতা করা। আর নতুন যাঁরা তাদের উচিত জেনে শুনে যেকোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যাওয়া। দেশের সরকারকে এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে হবে। যদিও ইতোমধ্যে অনেকে কাজ শুরু করেছেন। সকলের সাহায্যের হাত থাকলে আশা করি এই সমস্যার সমাধান হবে শিগগিরই।
বিবার্তা২৪.নেটঃ দেশের প্রেক্ষাপটে ফ্রিল্যান্সিং পেশায় নারীর অবস্থান কেমন?
মো. তরিকুল ইসলামঃ সম্ভাবনার আরও একটি বড় বিষয় হল এর সাথে নারীর সম্পৃক্ততা। আমাদের দেশে যেখানে উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে অনেক শিক্ষিত নারীও পড়াশোনা শেষ করে তেমন কিছু করেন না বা অনেকে করার সুযোগ পান না। সেখানে প্রচুর শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত নারী ফ্রিল্যান্সিং করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। নিজেরাই হচ্ছেন উদ্যোক্তা। সংসার সামলানোর সাথে সাথে ঘরে বসেই আয় করার সুযোগ পাচ্ছেন তারা। এতে করে নারীরা যেমন নিজেরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন তেমনি তারাও আবদান রাখছেন দেশের অর্থনীতিতে। আর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে নারীর স্বাধীনতা।
বিবার্তা২৪.নেটঃ বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং পেশার চ্যালেঞ্জসমূহ কি?
মো. তরিকুল ইসলামঃ ফ্রিল্যান্সিং একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। এখানে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। যেমন-বায়ারের বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝতে পারা, বায়ারকে নিজের বক্তব্য সঠিকভাবে বোঝাতে পারা এবং সেইসঙ্গে বায়ারকে কনভেন্স করতে পারাটাই হচ্ছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইংরেজি হচ্ছে যে কোনো ধরনের বায়ারের সঙ্গে যোগাযোগের মূল ভাষা। যে যত ভালো ইংরেজি পারে, সে তত বেশি ভালোভাবে বায়ারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এছাড়াও প্রজেক্টে বিড করা, কাজের মূল্য ও সময় নির্ধারণ করা, নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা, কাজের মান ঠিক রেখে সঠিক সময় সঠিক কাজটি ডেলিভারি দেয়া প্রতিটা ক্ষেত্রই একেকটা চ্যালেঞ্জ।
বিবার্তা২৪.নেটঃ ফ্রিল্যান্সিং এ ক্যারিয়ার গড়ার জন্য কি কি যোগ্যতা দরকার হয়?
মো. তরিকুল ইসলামঃ ইংরেজি হচ্ছে যে কোনো ধরনের বায়ারের সঙ্গে যোগাযোগের মূল ভাষা। যে যত ভালো ইংরেজি পারে, সে তত বেশি ভালোভাবে বায়ারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এ ধরনের ফ্রিল্যান্সারদের সঙ্গে বায়ার স্বাচ্ছন্দ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে দেখে দীর্ঘদিনের কাজের সম্পর্ক বজায় রাখে। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বহুদিন পর্যন্ত বায়ারদের কাছে নিজের চাহিদা ধরে রাখার জন্য সবসময় নতুন কিছু শেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
কেউ যদি এসইওর কাজের মাধ্যমে আউটসোর্সিং করে থাকেন, তাহলে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় এসইও সম্পর্কিত লেখা পাওয়া যায়, এরকম ব্লগগুলোর পোস্ট নিয়মিত পড়া উচিত। নতুন যত আপডেট আসছে, সবকিছু জেনে সেগুলোতে নিজেকে দক্ষ করতে হবে। ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার আগে ধৈর্য শক্তি বাড়িয়ে নেয়া উচিত। ধৈর্য নিয়ে কাজ শিখতে হবে। পরে শুরুতে কাজ পাওয়ার জন্য বহুদিন ধৈর্য সহকারে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। এমন হতে পারে, কাজ শেখার পর ১ম কাজের অর্ডার পেতে ১ বছরও লেগে যেতে পারে। কিন্তু তারপরও ধৈর্য হারালে চলবে না। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, নিজেকে দক্ষ করতে হবে, বায়ারের কাছে কাজ চাওয়ার ধরনে পরিবর্তন এনে দেখা যেতে পারে। হতাশ না হয়ে কাজ পাওয়ার ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
বিবার্তা২৪.নেটঃ ফ্রিল্যান্সিং পেশায় সফল হওয়ার গোপন রহস্য কি?
মো. তরিকুল ইসলামঃ টাকাকে নয় কাজকে ভালোবাসতে হবে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফলতার জন্য টাকার লোভ ত্যাগ করে কাজে দক্ষতা অর্জনের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। দক্ষ লোকদের সমাদর সব জায়গার মতো ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রেও। সেজন্য সবার প্রথমে বিভিন্ন রিসোর্স থেকে কাজ শিখে সেগুলোর বাস্তবভিত্তিক কাজ করে দক্ষতা অর্জন করলেই অনলাইনে কাজের রেট এবং চাহিদা দুটি বৃদ্ধি পাবে। এরকম চাহিদাপূর্ণ অবস্থানে আসার জন্য অবশ্যই কিছুটা সময় দিতে হবে। মনে রাখবেন, অদক্ষ ব্যক্তিদের টাকার পেছনে দৌড়াতে হয়। কিন্তু দক্ষ ব্যক্তিদের পেছনে টাকা দৌড়ায়।
ফ্রিল্যান্সিংকে শুধু পার্টটাইম হিসেবে নয়, ফুলটাইম ক্যারিয়ার ভাবা শুরু করতে হবে। কমিউনিকেশন দক্ষতা ফ্রিল্যান্সিংয়ের সফলতা অনেক বাড়িয়ে দেয়। ইংরেজিতে যত ভালো হবেন, তত বেশি সফল হবেন। যত বেশি দক্ষ হবেন, সফল হতে পারবেন তত বেশি। সবসময় নিজের আরও বেশি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নেশা থাকতে হবে। যে যত বেশি গুগলের ওপর নির্ভরশীল, তার সফলতার সম্ভাবনা তত বেশি। ইন্টারনেটের ওপর জীবনকে নির্ভরশীল করতে পারলে ফ্রিল্যান্সিং সফল হবেন। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ছাড়া কিছুতেই সফল হওয়া যায় না।
ধৈর্য শক্তি এ সেক্টরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মোট কথা হলো ফ্রিল্যান্সিং পেশায় সফল হতে হলে যে গুনগুলো একজন ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে অবশ্যই থাকা উচিত তা হল কাজের ক্ষেত্রে দক্ষতা, সততা, ধৈর্য, কঠোর পরিশ্রম এবং ইংরেজিতে যোগাযোগ করতে পারার ক্ষমতা।
বিবার্তা২৪.নেটঃ ফ্রিল্যান্সিং এ কাজ করতে যারা আগ্রহী তাদের জন্য পরামর্শ কি।
মো. তরিকুল ইসলামঃ নতুন যারা ফ্রিল্যান্সিং এ আগ্রহী তাদেরকে প্রথমেই বলবো কাজ শিখুন, কাজ পাবেন। ফ্রিল্যান্সিংটাকে শুধুমাত্র টাকা ইনকামের জায়গা মনে না করে এটিকে ক্যারিয়ার হিসেবে দেখার চেষ্টা করুন। আর কখনও শর্টকার্ট উপায়ে ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তা করলে হতাশ হতেই হবে। ৫বছর পর থেকে যদি সুখে থাকতে চান, তাহলে এখনকার সুখকে বিসর্জন দিন। পরিশ্রম করুন প্রচুর।
অনেকেই আছেন যারা অল্প অল্প কাজ শিখেই এপ্লাই করা শুরু করেন, এদের কেউ কাজ পেয়েও যায়। কিন্তু সফলতার সাথে সবাই কাজ শেষ করতে পারে না। তখন ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পরে। বাজে কমেন্ট ও ফিডব্যাক পাওয়ার কারণে নতুন কাজ পেতে সমস্যায় পরে। কিছুদিনের মধ্যেই হতাশ হয়ে পরে এবং অন্যকেও নিরুৎসাহিত করে। তাই কাজ ভালোভাবে শিখে তারপর শুরু করুন।
এরপর আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কমিউনিকেশন স্কিল। আমি এমন কিছু দক্ষ ডেভেলপারকে চিনি যারা অনেক কঠিন কঠিন সমস্যা খুব সহজেই সমাধান করতে পারেন। কিন্তু অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করতে গিয়ে সফল হতে পারেননি শুধুমাত্র ক্লায়েন্ট কি বলছে তা বুঝেননি অথবা ক্লায়েন্টকে বুঝাতে পারেননি তিনি কিভাবে কাজটি করবেন। এটি শুধুমাত্র কমিউনিকেশন স্কিলের অভাবে হয়। ইংরেজিতে অনেক ভালো না হলেও চলবে। কিন্তু নুন্যতম কমিউনিক্যাটিভ ইংলিশ জানা থাকতে হবে।
এরপর আসে ধৈর্যের কথা। নিয়মিতভাবে আপনার কাজ থাকবে কিংবা প্রতিমাসে আপনি অনেক অনেক টাকা কামাবেন এটা আশা করা ঠিক হবে না। এমন কিছু সময় আসবে যখন প্রচুর আবেদন করার পরও কোন রিপ্লাই পাবেন না। এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সারা বিশ্ব থেকে যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী আসবে সেখানে অনেক সময়ই কাজ না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয় নতুন কাজের জন্যে। তাই যারা এই চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে তাদেরই শুধু এ ধরনের কাজে আসা উচিত হবে। এছাড়াও কিছু কিছু খুঁটিনাটি বিষয় আছে যেগুলো সময়ের সাথে সাথে শেখা হয়ে যায়।
বিবার্তা/উজ্জল/মহসিন