মুমীতা মিশকাতের বেড়ে ওঠা ঢাকার লালমাটিয়া এলাকার স্বপ্নপূরী হাউজিং সোসাইটিতে। বাংলাদেশ রাইফেলস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে ইচ্ছে হয় ফার্মাসিতে পড়ার। তাই নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ব্যাচে ফার্মাসিতে স্নাতক ও স্নাকোত্তর শেষ করেন।
স্নাতক পড়ার সময়ই বিয়ে হয় মিশকাতের। ফ্রিল্যান্সিং করবেন এটা ভাবেননি তিনি। তার স্বামী মোস্তফা আল ইমরান এ পেশায় থাকায় কাজ শুরু করেন। প্রথম কিছুদিন স্বামীর কাজে সাহায্য করতেন মিশকাত। এর পরে ২০১২ সালে তিনি ওডেক্সে নিজের নামে একটি অ্যাকাউন্ট খুলেন। শুরু হয় তার ফ্রিল্যান্সার জীবন।
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আউটসোর্সিং করে নিজের জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি যারা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছেন তাদের উৎসাহ দিতে এবারও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) পঞ্চমবারের মতো দিয়েছে ‘বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড ২০১৫’। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে দেশ সেরা ৯৪ ফ্রিল্যান্সার ও আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করা হয়। এবার দেশসেরা ফ্রিল্যান্সারের মর্যাদা পেয়েছেন তিন নারী। মুমীতা মিশকাত তাদের মধ্যে একজন। গত বছর তার স্বামী ইমরানও এ পুরস্কার পেয়েছেন।
রাজধানীর মিরপুরে নিজ বাসায় কথা হয় তার সঙ্গে। বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড পেয়ে আনন্দিত মুমীতা জানান তার সেরা হয়ে ওঠার গল্প। সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছেন বিবার্তা২৪.নেটের নিজস্ব প্রতিবেদক- উজ্জ্বল গমেজ।
বিবার্তা২৪.নেটঃ ফ্রিল্যান্সিং কাজ করার উৎসাহ পেলেন কীভাবে?
মুমীতা মিশকাতঃ ২০১০ সালের কথা। আমার বড় বোন মেহেরুন নাহার ‘মনবুকাগাকুশসো’ স্কলাশিপ নিয়ে জাপান গিয়েছিল পড়াশুনা করতে। সে আমাকে লেপটপ কেনার জন্য টাকা পাঠায়। সেটাকা দিয়ে ২০১১ সালে একটা লেপটপ কিনি। কখনো ভাবিনি যে এই লেপটপই একদিন হবে ডলার আয়ের উৎস। আমার স্বামীর কাছ থেকেই প্রথম ফ্রিলেন্সিং বিষয়ে জানতে পারি। কথাগুলো শুনে প্রথমে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। ঘরে বসে লেপটপ দিয়ে কীভাবে দেশের বাইরে থেকে ডলার আয় করা সম্ভব? অবশ্য আমার স্বামীও একজন ফ্রিলেন্সার। তার অক্লান্ত পরিশ্রম, ধৈর্য, কাজের প্রতি আন্তরিকতা ধীরে ধীরে আমাকে ফ্রিলেন্সিং কাজের প্রতি উৎসাহিত করে।
বিবার্তা২৪.নেটঃ আপনার সাফল্যের মূলমন্ত্রটা জানতে চাই।
মুমীতা মিশকাতঃ সফলতা এমনিতে কারো কাছে ধরা দেয় না। পরিশ্রম করে সফলতাকে অর্র্জন করতে হয়। আমার সফল্যের মুলমন্ত্র যদি বলতে হয় তাহলে বলব কাজের প্রতি আমার আন্তরিকতা, একনিষ্ঠতা, বিশ্বস্ততা, ভালবাসা, ধৈর্য়, অধ্যাবসায় আর আত্মবিশ্বাস। আউটসোর্সিং এমন একটা ক্ষেত্র এখানে একজন ফ্রিল্যান্সারকে ধৈর্য নিয়ে কাজে লেগে থাকতে হয়। এরপর যেটা প্রয়োজন সেটা হলো শেখার ও জানার আগ্রহ। আমি প্রতিদিনই অনেক পড়াশুনা করি।
বিবার্তা২৪.নেটঃ আপনার এই সাফল্যের পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?
মুমীতা মিশকাতঃ জীবনে সফলতার পেছনে কারো না কারো অবদান থাকে। আমি বলব আমার পক্ষে বেসিস অ্যায়ার্ড পাওয়া সম্ভব হতো না যদি আমার স্বামী আমাকে সব দিক থেকে সাপোর্ট না করতো। এ কাজ করতে আমাকে সবসময় পাশে থেকে আমাকে সাহস ও সমর্থন দিয়েছে, উৎসাহ যুগিয়েছে, গাইড করেছে আমার স্বামী। আমার এই সাফল্যের পেছনে পরিবারের অবদান সবটুকু।
বিবার্তা২৪.নেটঃ সেদিনগুলোর কথা বলুন যখন আপনাকে আউটসোর্সিং কাজে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে।
মুমীতা মিশকাতঃ আসলে ফ্রিল্যান্সিংয়ের শুরুতে কাজ পাওয়াটা অনেক চ্যালেঞ্জের ছিল। আমাকে নানা ধরণের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। নতুন হিসেবে ক্লাইন্টদের পাওয়া কঠিন ছিল। তারা আমাকে চেনে না, জানে না। তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে আমাকে অনেক ধৈর্যের কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছে। রাত জেগে কষ্ট করে কাজ করে ক্লিইন্টদের দিলে তারা উত্তর দিতো তাদের মনের মতো হয় নাই। কাজের কোয়ালিটি ভাল না। আরো নানা ধরণের কমেন্ট। সেগুলো মনে অনেক কষ্ট দিতো। অনেক সময় কাজের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। মন ভেঙে যেত। তবে হাল ছেড়ে দেইনি। আবার কষ্ট করে ক্লাইন্টদের পছন্দ মতো করে কাজ পাঠিয়েছি।
বিবার্তা২৪.নেটঃ এত পরিশ্রমের অনুপ্রেরণা পান কোথা থেকে?
মুমীতা মিশকাতঃ ফ্রিল্যান্সিং জগত থেকে। একটা সময় ছিল যখন আমি নিজে কিছু লিখতাম না। এখন কাজের প্রয়োজনে প্রতিদিন অনেক বিষয়ে লিখতে হচ্ছে। তাছাড়া প্রযুক্তিনির্ভর এই আউটসোর্সিং কাজটাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। এটা আমার নিজস্ব জগত হয়ে গেছে। আমি কাজে প্রচুর আনন্দ পাই, কাজকে উপভোগ করি। সারা রাত জেগে কষ্ট করে কাজ করে ক্লাইন্টদের কাছে পাঠালে তারা এখন খুশি হয়। আমার ফিটব্যাকও ভাল দিচ্ছে। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাপ্তিই আমাকে কাজের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগায়।
বিবার্তা২৪.নেটঃ আপনি এখন কী করছেন?
মুমীতা মিশকাতঃ আমি আউটসোর্সিং কাজ শুরু করি teaching হিসেবে। মূলত শিক্ষাক্ষেত্রের কাজগুলো নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং শুরু হয়। এগুলো এখনো অব্যাহত রেখেছি। বর্তমানে কাজ করছি জেনারেল অ্যান্ড মেডিকেল আর্টিক্যাল রিসার্চ, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রিসার্চ, মেডিক্যাল আর্টিকেল রাইটিং, মেডিক্যাল ডাটাবেস রিসার্চ ইত্যাদি। বর্তমানে কাজ করছি একটি কানাডিয়ান কোম্পানির সাথে।
বিবার্তা২৪.নেটঃ ফ্রিল্যান্সিং-কাজের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
মুমীতা মিশকাতঃ ফ্রিল্যান্সিং নামটি যত সহজ মনে হয়, আসলে কাজের ক্ষেত্রে ততটা নয়। ফ্রিল্যান্সিং মানে ঘরে বসে কারার অলস কাজ নয়। এটি একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। যেমন-প্রজেক্টে বিড করা, কাজের মূল্য ও সময় নির্ধারণ করা, যোগাযোগ রক্ষা করা, কাজের মান ঠিক রেখে সঠিক সময় সঠিক কাজটি ডেলিভারি দেয়া, বায়ারকে সন্তুষ্ট করা-প্রতিটি ক্ষেত্রই একেকটা চ্যালেঞ্জ।
বিবার্তা২৪.নেটঃ দেশের ফ্রিল্যান্সিংকে নিয়ে আপনার ভবিষ্যত স্বপ্ন কী?
মুমীতা মিশকাতঃ আমার ভাবিষ্যত স্বপ্ন হলো দেশের ফ্রিল্যান্সারদের নিয়ে একটা টিম গঠন করার। আউটসোর্সিং বেসিস অ্যায়ার্ড-২০১৫ আমাকে এই কাজ কারার আরো উৎসাহ দিয়েছে। ফলে দেশের ফ্রিল্যান্সারদের জন্য কিছু কারার আমার দায়িত্বও বেড়ে গেছে। এক বছর আগে অবশ্য আমি এই কাজ শুরু করেছি। আমি এখন চেষ্টা করছি আউটসোর্সিং কাজে আরো ফ্রিল্যান্সারদের যুক্ত করতে, যাতে বেকার তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থান তৈরি হয়। ইতোমধ্যে আমি আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছি। তাদের কাজ দিয়ে পরীক্ষা করছি। যারা ভালভাবে সঠিক সময়ে আমাকে কাজ করে দিচ্ছে তাদের আমি পারিশ্রমিকও দিচ্ছি। ভবিষ্যতে আমার ইচ্ছা তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর উদ্যোক্তা হয়ে বড় পরিসরে এই ট্রেনিংটা চালিয়ে যাওয়ার। এই কাজটা চালিয়ে নিতে প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য দরকার। যদি না পাই-‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ কিন্তু আমাকে সফল হতেই হবে।
বিবার্তা২৪.নেটঃ ফ্রিল্যান্সিংয়ে যারা আসতে চায় তাদের জন্য কিছু বলুন।
মুমীতা মিশকাতঃ ফ্রিলান্সিং মানে ঘরে বসে বিদেশ থেকে ডলার আয় করার অলস কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম আর কাজ করার প্রবল ইচ্ছা শক্তি। এখানে নিজের মনোবলেই একা একা কাজ করে যেতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত জ্ঞান আর উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। ফ্রিল্যান্সিং সাইটে হাজারো কাজ আছে। তাই এ কাজ করলে অর্থের সংস্থান হবে এটা ঠিক। তবে ভালো মানের একজন ফ্রিল্যান্সার হতে হলে ভালোভাবে শিখে বা প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজে হাত দিতে হবে। আর ইংরেজি ভাষার দক্ষতা থাকতে হবে। তবেই সফল হওয়া যাবে।
বিবার্তা২৪.নেটঃ আমাদের নিউজ পোর্টালে আপনার মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য বিবার্তা২৪.নেটের সকল পাঠকদের পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মুমীতা মিশকাতঃ আমার সাফল্যের কথা আপনাদের নিউজ পোর্টালে প্রকাশ করার জন্য আপনারদেরও অনেক ধন্যবাদ।
বিবার্তা/উজ্জল/প্লাবন.