শফিউল আলম প্রধান বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক আলোচিত ব্যক্তিত্ব। স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নেওয়া এই নেতার রয়েছে ৪৫ বছরের টানা আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিহাস।বর্তমানে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন, অতীত ইতিহাসসহ সার্বিক বিষয়ে তার আসাদগেট অফিসে বিবার্তার সাথে একান্ত সাক্ষাতকালে খোলামেলা আলাপ করেন। সাক্ষাতকারটি গ্রহণ করেছেন বিবার্তার নিজস্ব প্রতিবেদক জাহিদ হোসেন বিপ্লব।
বিবার্তা : ২০ দলীয় নেত্রী বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
শফিউল আলম প্রধান : দেশদ্রোহী শক্তি যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তখন দেশপ্রেমিকদেরই রাষ্ট্রদ্রোহের কাঠগড়ায় দাড় করানো হয়। শেখ হাসিনার ভালো জানার কথা ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খাঁন ৬৮ তে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দিয়েছিলো। পরিণামে আইয়ুব ক্ষমতা হারিয়েছে আর মুজিব বীরের বেশে জেল থেকে বের হয়েছেন। তিনি বলেন, বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা প্রত্যাহার করা না হলে শেখ হাসিনাকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে।
বিবার্তা: ২০ দলীয় জোটে কী কার্যকরভাবে ২০ দল আছে? অনেকেইতো আপনাদের জোট থেকে বের হয়ে গেছেন?
শফিউল আলম প্রধান : তৃতীয় বিশ্বে এ ধরণের ঘটনা ঘটতেই পারে। যেমন শেখ সাহেবের জীবিতকালেই আওয়ামী লীগ দু’টুকরা হয়েছিলো এবং তার মৃত্যুর পর এই আওয়ামী লীগ চার টুকরায় পরিণত হয়েছিলো। এখানে মনে রাখতে হবে ২০ দলের বাতিঁঘর হচ্ছে দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। সুতরাং তিনি যতদিন এই জোটের নেতৃত্বে আছেন সরকার যতই চেষ্টা করুক না কেন কোনো লাভ নেই। এই জোট ছিলো, আছে এবং থাকবে।
বিবার্তা : আপনিতো এক সময় এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে ছিলেন, জাতীয় পার্টিতে সম্প্রতি যে নয়া মেরুকরণ হলো তাতে আপনার মন্তব্য কী?
শফিউল আলম প্রধান : জাতীয় পার্টিতে আমার তীক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এখনও আমি সংশয়মুক্ত নই। তবে জিএম কাদের যদি ক্ষমতার মোহ এবং ভীতি উপেক্ষা করে গণতন্ত্রের পথে হাটেন তাহলেই এ দলটি আবার জনতার কাতারে আসতে পারবে বলে আমার মনে হয়।
বিবার্তা : জাতীয় পার্টিতে লোক দেখানো কোনো নাটক চলছে বলে আপনার মনে হয়?
শফিউল আলম প্রধান : আমার মনে হয় না। তবে এখন এটাকে নাটক বানানো হলে তাদের পরিণতি হবে কৌতুক অভিনেতার মত।
বিবার্তা : আপনার জাগপার বয়স ৩৫, এই দীর্ঘসময়েও সংগঠনকে বিকশিত করতে পারলেন না কেন?
শফিউল আলম প্রধান : এর কারণ মাত্র একটা, আর তা হলো এখানে গণতন্ত্রকে কখনই বাধামুক্তভাবে চলতে দেওয়া হয়নি। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক দল বিকশিত করা যায় না। তারপরও আমি বলবো ইতোমধ্যে ৪০টি জেলায় জাগপার পতাকা উড়ছে।
বিবার্তা : আপনি কি মনে করেন বিএনপি নির্ধারিত সময়ে কাউন্সিল করতে পারবে?
শফিউল আলম প্রধান : এই কাউন্সিল ভন্ডুল করার অপচেষ্টা সফল হবে না। আমার বিশ্বাস ১৯ মার্চই বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হবে ইনশাল্লাহ।
বিবার্তা : দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন মনে হয় আপনার কাছে?
শফিউল আলম প্রধান : আইনের রক্ষক যারা সেই পুলিশ বাহিনীকে সরকার রাজনৈতিক প্রয়োজনে অপব্যবহার করছে। তাতে করে আইন আছে কিন্তু শৃঙ্খলা ও বাস্তবায়ন নেই।
বিবার্তা : আপনিতো এক সময় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, সেই ছাত্রলীগ সম্পর্কে কিছু বলুন।
শফিউল আলম প্রধান : আমি যেই ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম সেই ছাত্রলীগ আজ আর নাই। বর্তমান ছাত্রলীগের তাণ্ডব, সন্ত্রাস, লুটপাট দেখছি শুনছি এবং পড়ছি তাতে আমার মনে রক্তক্ষরণ হয়।
বিবার্তা : বিএনপি একটি বড় এবং জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল, তারপরও আপনাদের আন্দোলনে সফলতা আসছে না কেন?
শফিউল আলম প্রধান : আন্দোলন সম্পর্কে আমাদের নেতাকর্মীদের মাঝে একটি অলীক ধারণা আছে। মনে রাখতে হবে গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম কখনো ক্ষণস্থায়ী, কখনো দীর্ঘস্থায়ী আবার কখনো অনন্ত যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। যেমন আইয়ুব শাসন টানা দশ বছর চলেছে। এমনকি খালেদা-হাসিনা, জামায়াতসহ সকল বাম সংগঠন একজোটে আন্দোলন করা সত্বেও এরশাদের শাসন টানা নয় বছর টিকেছে। সুতরাং এমনতো হতেই পারে। তবে মনে রাখতে হবে শেষ হাসি বেগম খালেদা জিয়াই হাসবেন।
বিবার্তা : আপনাকে কেন সেভেন মার্ডারের আসামি করা হয়েছিলো?
শফিউল আলম প্রধান : ৭৪ সালে আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ক্ষমতাসীন দলের একাংশের দুর্নীতি, দুঃশাসন এবং লুন্ঠনের বিরুদ্ধে আমার নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে ওঠে। ৭৪ সালের ৩০ মার্চ বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ছাত্র-জনসমাবেশে ৬৪ জন সেরা দুর্নীতিবাজের তালিকা প্রকাশ করি এবং ২৯ এপ্রিলের মধ্যে তাদের গ্রেফতার ও বিচারের আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। ছাত্রলীগ ছিল সে সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মূল শক্তি। এই ছাত্র বিদ্রোহে ভীত, সংকিত আওয়ামী কায়েমী স্বার্থ আমাকে এবং আমার সহকর্মীদের গ্রেফতার করে এই পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র মামলায় আমাকে জড়িয়ে দেয়। আমাদের কারাগারে রেখে দেশে জরুরি আইন জারি করা হলো। আর আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করে কায়েম করা হলো বাকশাল।
বিবার্তা : জেল থেকে কতদিন পর ছাড়া পেলেন এবং জাগপা গঠন করলেন কিভাবে?
শফিউল আলম প্রধান : আমি ৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মুক্তি লাভ করি এবং আমার অনুসারি ছাত্রলীগ কর্মীদের আবার সংগঠিত করলাম। তারপর ৮০ সালের ৬ এপ্রিল আমাকে আহবায়ক করে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি আত্মপ্রকাশ করে। এরপর জাগপার দীর্ঘ টানা সংগ্রামের ইতিহাস। জাগপা প্রতিষ্ঠার পরে আন্দোলন সংগ্রামের অপরাধে নয় বার গ্রেফতার হয়েছি।
শফিউল আলম প্রধান ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি পঞ্চগড় জেলা সদরের রাজানগরে ঐতিহ্যবাহি প্রধান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম গমীর উদ্দিন প্রধান পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের শেষ স্পিকার ছিলেন। মাতা মরহুমা বেগম শামসুন্নাহার প্রধান।
১৯৬৭-৬৮ সালে শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজের নির্বাচিত জিএস ছিলেন তিনি। ৬৯-৭০ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের ভিপি নির্বাচিত হন। এরপর ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পাঠচক্র সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৭৩ সালে নভেম্বর মাসে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
শফিউল আলম প্রধান যে কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন মনিরুল হক চৌধুরী, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এবং দফতর সম্পাদক ছিলেন আজকের যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
প্রধান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৪ সালে সংগঠিত সেভেন মার্ডার মামলার আসামী হয়ে তখন ব্যাপক আলোচিত- সমালোচিত হন। শফিউল আলম প্রধানের স্ত্রী রেহানা প্রধান কলেজে অধ্যাপনা করেন। তিনি ্একসময় ছাত্রলীগৈর কেন্দ্রীয় নেত্রী ছিলেন।
বিবার্তা/বিপ্লব/মহসিন